এই ভাবেই নদীর বুক খুঁড়ে তোলা হয় বালি।—ফাইল চিত্র।
চওড়া নদীর চড়া অংশে জল হাঁটু সমান। সেখানে কলেজপড়ুয়া ছয় বন্ধু ছোটাছুটি করে আনন্দ করছিলেন। টের পাননি, যন্ত্র দিয়ে বালি তোলায় নদীর বুকে তৈরি হয়েছে মরণফাঁদ। সেখানে পা পড়তেই তলিয়ে যান দু’জন। দিন দুয়েক আগে ব্যারাজ থেকে জল ছাড়ায় ওই গর্তে ঘুর্ণিও তৈরি হয়েছিল। তাই আশুতোষ কলেজের দুই ছাত্র তন্ময় প্রামাণিক (১৮) আর অতনু রাজবংশীকে (১৯) চোখের সামনে তলিয়ে যেতে দেখেও কিছু করতে পারেননি তাঁদের বন্ধুরা। শনিবার সকালে দু’জনের দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
তন্ময়, অতনুর সহপাঠী ইনজামামউল হক বলেন, “ওখানে এতটা গভীর গর্ত আছে বোঝাই যায়নি। সকলেই ওখানে ঢুকে যেতে পারতাম।” দুর্ঘটনার কথা শুনে জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি রমাপ্রসাদ গিরি। তিনিও বলেন, “এই জায়গাটি বালি তোলার জন্য খুবই গভীর। আগেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
বস্তুত কংসাবতীর মেদিনীপুর রেলব্রিজ লাগোয়া এলাকাটি বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করেছে সেচ দফতরই। গত বছর মুখ্যমন্ত্রীর দফতরকে পাঠানো একটি রিপোর্টে সেচ দফতর জানায়, রাজ্যের ২৪৮টি জায়গায় নদী থেকে বালি তোলা হচ্ছে বলে নদীখাতের অবস্থা ভয়াবহ। সেই তালিকাতেই রয়েছে এই এলাকাটি, জানালেন সেচ দফতরের এক কর্তা।
স্থানীয় সূত্রে খবর, মেদিনীপুর রেল সেতু থেকে শুরু করে বাস যাতায়াতের জন্য তৈরি বীরেন্দ্র সেতু - এই সুদীর্ঘ এলাকা জুড়েই নদীর স্থানে স্থানে এমন মরণফাঁদ রয়েছে। প্রতি বছরই ঘটছে দুর্ঘটনা। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বছরে গড়ে ২-৩ জনের মৃত্যু হয়। অবৈধভাবে বালি তোলার মরণফাঁদ তৈরির পাশাপাশি, নষ্ট হয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ আমলের তৈরি অ্যানিকেত। যা দিয়ে বাঁধে জল আটকে রাখা হত। গ্রীষ্মে সেই জল ছাড়া হত সেচের জন্য। তাতে উপকৃত হতেন ৫টি ব্লকের প্রায় ৮০ হাজারেরও বেশি কৃষক। এখন তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। বাস সেতু, রেল সেতুও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বালি মাফিয়াদের নিয়ে এক সময় তোলপাড় হওয়ায় জোরদার তল্লাশি চালিয়ে অবৈধ বালি খাদান বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর জরিমানা ও নির্দিষ্ট এলাকায় খাদান তৈরির অনুমতি দিয়ে কোটি কোটি টাকা রাজস্বও আদায় করেছিল। তারপর বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল যে, বালি তোলার তত্ত্বাবধান করবে সেচ দফতর। তা হলে এই দশা কেন? বালি তোলার দায়িত্ব সেচ দফতর দেওয়ার নিদের্শিকা তৈরিও হয়েছিল। কিন্তু চলতি আর্থিক বছরে তা করা হয়নি। রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “নির্বাচন শেষ হলে আমরা দায়িত্ব পেয়ে যাব বলে আশা করছি।”
নবান্ন সূত্রের খবর, বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্যের সমস্ত জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের ২০১৩ সালের ২৬ জুলাই চিঠি দিয়েছিলেন সেচ দফতরের তৎকালীন যুগ্ম সচিব। কিন্তু তাতেও কমেনি বালি ও মাটি মাফিয়াদের দাপট। গোটা বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। অবৈধ ভাবে বালি তোলার জন্য নদীর ক্ষতি হচ্ছে, সে বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।
এরই মধ্যে বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ আসে। গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠাতে বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভুমের পুলিশ সুপার এবং জেলাশাসকদের মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেচ দফতর রাজ্যের ২৪৮টি এলাকা চিহ্নিত করে, যেখানে বালি তোলার জন্য নদীখাতের অবস্থা ভয়াবহ। তার মধ্যে কংসাবতীর মেদিনীপুর রেলব্রিজ লাগোয়া এলাকাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন সেচ দফতরের কর্তারা।
সেচ দফতরের এক কর্তার কথায়, বালি মাফিয়াদের রুখতে চাই আরও কঠোর আইন। তিনি বলেন, “বাম আমলে ২০০২ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইনর মিনারেল আইন করা হয়। কিন্তু সেই আইন খুবই দুর্বল। ওই আইন দিয়ে বালি মাফিয়াদের দমন করা কার্যত অসম্ভব ছিল। তাই পুরোনো আইন বাতিল করে নতুন আইন তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নতুন আইনে বেআইনি ভাবে যারা বালি তুলছে তাঁদের জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।”
নতুন আইন, নতুন বিজ্ঞপ্তি পাওয়ার আগেই আরও কত প্রাণ চলে যাবে, সেই প্রশ্নই করছেন রাজ্যবাসী।