নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন পায়েল। —নিজস্ব চিত্র।
কোচিং ক্লাসে অনুপস্থিত থাকার শাস্তি হিসেবে এক ছাত্রীকে পাঁচশো বার কান ধরে ওঠবোস করানোর অভিযোগ উঠল ঝাড়গ্রামে।
বুধবার সকালে ঝাড়গ্রামের একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষকের শাস্তির জেরে পায়েল রায় নামে দশম শ্রেণির ওই ছাত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। পায়েল বাড়ি গিয়ে সমস্ত ঘটনার কথা জানায়। রাতে পায়েল অসুস্থ হয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার সকালে তাকে ঝাড়গ্রাম শহরের একটি নাসিংহোমে ভর্তি করানো হয়। শুক্রবার পায়েলের বাবা সিদ্ধার্থ রায় ঝাড়গ্রাম মহিলা থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ পেয়ে এ দিন ওই নাসিংহোমে গিয়ে পায়েলের সঙ্গে কথা বলে মহিলা থানার পুলিশ। কোচিং সেন্টার কর্তৃপক্ষ ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পায়েলের সহপাঠীদেরও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত কোচিং সেন্টারের ইতিহাসের শিক্ষক পিন্টু প্রতিহারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ঝাড়গ্রামের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ বলেন, “ওই ছাত্রীর বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু হয়েছে। অভিযুক্ত শিক্ষক ফেরার। তাঁর খোঁজ চলছে।”
ঝাড়গ্রাম শহরের জামদা এলাকার বাসিন্দা পায়েল শহরেরই বাছুরডোবার ননীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ওই স্কুল চত্বরের একটি কোচিং সেন্টারে পায়েল পড়ত। অভিযোগ, গত বুধবার সকালে কোচিং সেন্টারে পড়তে গেলে ইতিহাসের শিক্ষক পিন্টু প্রতিহার দেরি করে আসার জন্য পায়েলকে পাঁচশো বার কান ধরে ওঠবোস করান। পায়েলকে মারধরও করেন ওই শিক্ষক। শাস্তির জেরে পায়েল অসুস্থ হয়ে জল খেতে চাইলে ওই শিক্ষক তাকে জল খেতেও দেননি। এমনকী ওঠবোস করানোর পর পিন্টুবাবু ক্লাস ঘরের সিলিং ফ্যানও বন্ধ করে দেন বলে অভিযোগ। ঘটনার পর থেকে লালগড়ের বেলাটিকরি এলাকার খোসা গ্রামের বাসিন্দা পিন্টুবাবুর খোঁজ মেলেনি। শুক্রবার নার্সিংহোমের শয্যায় শুয়ে পায়েল জানায়, “মঙ্গলবার পারিবারিক সমস্যার কারণে কোচিং সেন্টারে যেতে পারি নি। বুধবার কোচিং সেন্টারে গিয়েছিলাম। ইতিহাসের ক্লাস নেওয়ার সময় পিন্টু স্যার অনুপস্থিতির জন্য আমাকে বকাবকি করেন। এরপর আমাকে কোচিং রুমের বারান্দায় পাঁচশো বার গুনে গুনে কান ধরে ওঠবোস করতে বলেন।” সে আরও বলে, “প্রায় দু’ঘণ্টা কান ধরে ওঠবোস করার পরে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। এরপর আমি জল খেতে চাইলে পিন্টু স্যার জল দেন নি। কোচিং রুমে বসার পরে সিলিং ফ্যানও বন্ধ করে দিয়ে পিন্টু স্যার বলেন, অনুপস্থিতির এটাই শাস্তি। আমার শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।” তদন্তকারী পুলিশের কাছে পায়েল জানায়, এর আগেও ওই শিক্ষক তাকে ও আরও কয়েকজন সহপাঠীকে পড়া না পারার জন্য দু’শো বার কান ধরে ওঠবোস করিয়েছিলেন।
শুক্রবার অভিযুক্ত পিন্টু প্রতিহারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার কথা স্বীকার করে বলেন, “বিষয়টা এত বড় আকার নেবে বুঝতে পারিনি। পায়েল প্রি-টেস্টে খুব কম নম্বর পেয়েছিল। মাঝে-মাধ্যেই ও কোচিং ক্লাসে অনুপস্থিত থাকত। তাই অনুপস্থিতির জন্য পায়েলকে পাঁচশো বার কানধরে ওঠবোস করতে বলি। কিন্তু ও কতবার ওঠবোস করেছে তা গুনিনি।” পায়েলকে ওঠবোস করানোর পর জল না দেওয়ার প্রসঙ্গে পিন্টুবাবুর সাফাই, “অতবার কানধরে ওঠবোস করার পরে জল খেলে যদি কোনও বিপদ হত, তাই পায়েলকে জল দিই নি। আর, ওই সময় বোধহয় লোডশেডিং থাকায় সিলিং ফ্যান বন্ধ ছিল।” ঘটনার পর থেকে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেন পিন্টুবাবু।
অভিযুক্ত শিক্ষককে আড়াল করার অভিযোগ উঠেছে কোচিং সেন্টার-কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সিদ্ধার্থবাবু বলেন, “কোচিং সেন্টার কর্তৃপক্ষ মিটমাট করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। আমি মীমাংসায় আগ্রহী নই। আমার মেয়েকে যে অমানবিক শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তা যেন আর অন্য কাউকে পেতে না হয়। সেজন্যই পুলিশে অভিযোগ করেছি।” যদিও কোচিং সেন্টারের মালিক অলোক মাহাতো বলেন, “ঘটনাটি জানার পরে আমি একাধিকবার অভিযুক্ত শিক্ষকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি। কিন্তু উনি আসেন নি। ওই শিক্ষককে আমি বরখাস্ত করেছি। অসুস্থ ছাত্রীটিকে নার্সিং হোমে গিয়ে দেখে এসেছি।” তবে পরিবারকে পুলিশে যেতে মানা করার অভিযোগ অস্বীকার করে অলোকবাবুর দাবি, “পায়েলের পরিবারের পাশে আমি রয়েছি। চিকিৎসার খরচও দেব বলেছি। আমিও চাই পিন্টুবাবুর শাস্তি হোক।”
এ দিন ননীবালা বালিকা বিদ্যালয়েও তদন্তে যায় পুলিশ। স্কুলের-টিচার ইনচার্জ মনোরমা ঘোড়াই বলেন, “স্থানীয় এক যুবকের অনুরোধে স্কুল পরিচালন কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে আমাদের স্কুলের দু’টি ক্লাস রুম নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুল শুরুর আগে ওই কোচিং সেন্টারের শাখা সেন্টারটি চলত। তবে এই ঘটনার পরে স্কুল চত্বরে ওই শাখা কেন্দ্রটি চালাতে দেওয়া হবে না বলে কোচিং সেন্টার কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি।” নার্সিংহোমের চিকিৎসক সঞ্জয় নন্দী বলেন, “যন্ত্রণার জন্য পায়েলের জ্বর হয়েছিল। শ্বাসকষ্টের সমস্যাও ছিল। তবে এখন অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল।”