একাংশের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে, মানছে সিপিএম

বামেদের ভোটব্যাঙ্কে রক্তক্ষরণ অব্যাহত। জনসমর্থনে ব্যাপক ধস স্বভাবতই বাম নেতৃত্বের চিন্তা বাড়িয়েছে। লোকসভায় ভরাডুবির পরে নেতৃত্ব বদলের দাবি উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে দলের একাংশ নেতা-কর্মীর গ্রহণযোগ্যতা একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে বলে মেনে নিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএম। দলের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলেন, “লোকসভার ফলাফলের প্রাথমিক পর্যালোচনা হয়েছে। সেখানে কিছু দিক উঠে এসেছে। আগামী দিনে আরও গভীর পর্যালোচনা হবে।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৪ ০১:০৫
Share:

বামেদের ভোটব্যাঙ্কে রক্তক্ষরণ অব্যাহত। জনসমর্থনে ব্যাপক ধস স্বভাবতই বাম নেতৃত্বের চিন্তা বাড়িয়েছে। লোকসভায় ভরাডুবির পরে নেতৃত্ব বদলের দাবি উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে দলের একাংশ নেতা-কর্মীর গ্রহণযোগ্যতা একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে বলে মেনে নিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএম। দলের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলেন, “লোকসভার ফলাফলের প্রাথমিক পর্যালোচনা হয়েছে। সেখানে কিছু দিক উঠে এসেছে। আগামী দিনে আরও গভীর পর্যালোচনা হবে।”

Advertisement

জেলার লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের প্রাথমিক পর্যালোচনা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমাদের জেলায় লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। গত জেলা জমায়েত এবং ব্রিগেড জমায়েতের মাধ্যমে উৎসাহিত আমাদের কর্মী-বাহিনী নির্বাচনী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। তবে সাফল্য আসেনি। এক ধরনের কমরেড দলে আছে, যাঁদের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে। এঁদের পক্ষে মানুষের কাছে রাজনৈতিক প্রচারে যাওয়া সম্ভব ছিল না।’

দলীয় সূত্রে খবর, লোকসভার ফলাফলের প্রাথমিক পর্যালোনায় গত সপ্তাহে বৈঠকে বসেন জেলা সিপিএম নেতৃত্ব। তারপরই এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়। ভরাডুবির দায় যে দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীরও, রিপোর্টে তারও উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনী বিপর্যয়ের দায়িত্ব জেলা নির্বাচনী কমিটি হিসেবে জেলা সম্পাদকমণ্ডলী অস্বীকার করছে না। এটা ঠিক জেলা সম্পাদকমণ্ডলী সংগ্রামের পরিকল্পনা এবং তার রূপায়ণের সাপ্তাহিক পর্যালোচনা করেছিল। কিন্তু সেই সব পর্যালোচনায় দুর্বলতাগুলো সংশোধন করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি।’

Advertisement

পশ্চিম মেদিনীপুরে এ বার বামেদের জনসমর্থন ব্যাপক হারে কমেছে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যেখানে বামেদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৪ শতাংশ। সেখানে লোকসভায় তা কমে হয়েছে ২৯ শতাংশ। জেলায় ১৯টি বিধানসভার সব কটিতেই বামেদের ভোট কমেছে। বামেদের সবথেকে বেশি ভোট কমেছে কেশপুর, গড়বেতা, কেশিয়াড়িতে। বস্তুত, জেলায় বামেদের প্রাপ্ত ভোট যেখানে ২৯ শতাংশ, সেখানে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৫১ শতাংশ। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ১০ শতাংশ। পশ্চিম মেদিনীপুরের সর্বত্র বিজেপির তেমন সংগঠন নেই। কার্যত বিনা সংগঠনেই বিজেপির এই ভোটপ্রাপ্তিকে মোটেও লঘু করতে দেখতে চাইছেন না জেলা সিপিএমের একাংশ। কেন এই ভরাডুবি? জেলা সিপিএম নেতৃত্ব প্রাথমিক ভাবে ১৯টি কারণ খুঁজে বের করেছেন। পর্যালোচনা রিপোর্টে তার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।

জেলা নেতৃত্বের মতে, নির্বাচনী কমিটিগুলোর মধ্যে যে কমিটি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই কমিটি গঠন ও পরিচালনার দুর্বলতাই হল সাংগঠনিক বিপর্যয়ের অন্যতম বিষয়। দলের জেডসিএম, এলসিএম ও শাখা সম্পাদক-সহ দলীয় সদস্যদের একটা অংশ ধারাবাহিক ভাবে নিষ্ক্রিয় থেকে যাচ্ছিল। এই ধরনের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের একাংশ গোপনে জরিমানা দিয়ে শান্তি কিনেছিল। একাংশ শক্রুর নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল। আবার একটা অংশ রাজনৈতিক কাজকর্ম থেকে দূরে থাকার মুচলেকা দিয়ে এলাকায় অবস্থান করছিল। এদের অনেককেই চিহ্ণিত করা যায়নি। আবার চিহ্ণিত করা গেলেও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এই অজুহাতে যে তারা বিপক্ষে যোগ দিলে আমাদের সংগঠনের ক্ষতি হবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বুথ এলাকায় বসবাসকারী পিএম, সিএম ও এজিএমদের নিয়ে এক-একটি পার্টি টিম গঠন করে বুথ কমিটিকে পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয় কার্যক্ষেত্রে অস্তিত্বহীন থেকে গিয়েছে। কতজনের উপস্থিতিতে কতজনের বুথ কমিটি গঠিত হয়েছে, সেই ধরনের তথ্যপ্রকাশ করতে নেতৃস্থানীয় কমরেডরাও এগিয়ে গিয়েছেন।’ জেলা নেতৃত্বের পর্যালোচনা, পরিবারে পরিবারে বারেবারে গিয়ে দলের আবেদন জানানো, তাদের কথা ধৈর্য ধরে শোনার দুর্বলতা থেকেই গিয়েছিল। তাই বিরোধীদের বহুমুখী প্রচারের তোড়ে দলের প্রচার দাগ কাটতে পারেনি। বিকল্প নীতি সম্পর্কে বামেরা যা বলেছে, তার বাস্তবে রূপায়ণ করার ক্ষেত্রে যুক্তিগ্রাহ্য সর্বভারতীয় কোনও শক্তির বাস্তবতা মানুষ খুঁজে পায়নি।

‘লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল জানিয়ে দিচ্ছে যে বামপন্থী আন্দোলনের উপর এই জেলার মানুষের যে ঐহিত্যবাহী সমর্থন ছিল তা যথেষ্ট ক্ষয় হয়েছে’, মেনেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘আমাদের জেলায় সিনেমার দু’জন সুপারস্টারকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। প্রার্থী হিসেবে জনমানসে তেমন দাগ কাটতে না পারলেও তাদের উপস্থিতিতে জনসভাগুলোতে যুবক-যুবতীদের উপস্থিতি এবং তাদের কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল। তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও আমাদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব এখনও তৈরি হয়নি। একথাও উপলব্ধি করতে হবে যে মাওবাদী আঘাতে দীর্ন এলাকায় আপাত শান্ত থমথমে ভাব থাকায় এবং দু’টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া চালিয়ে যাওয়ায়, কন্যাশ্রী প্রকল্প, বেকার যুবদের একাংশকে ভাতা প্রদান, ক্লাবের নামে তৃণমূলী যুবদের একাংশের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেওয়ার মতো কয়েকটি প্রকল্প এবং মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জেলায় নানা প্রকল্পের শিলান্যাস করার ফলে তার ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় জনমানসের একাংশকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছে।’ আরও বলা হয়েছে, ‘লোকসভা নির্বাচনে আমাদের গণসংগঠনগুলোর ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সময়কালে গণসংগঠনগুলোর সদস্য সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছে। গণআন্দোলন ও শ্রেণি-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গণসংগঠনগুলোর উদ্যোগের ঘাটতি থেকে গিয়েছে। শুধুমাত্র যুব সংগঠনের পক্ষ থেকে নিজস্ব উদ্যোগে কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement