গ্রামে ফিরতে চান লক্ষ্মী

ঘরে ফিরতে চান লক্ষ্মী। কিন্তু সত্যিই কি সে পরিবেশ তৈরি হয়েছে?

Advertisement

অভিজিৎ চক্রবর্তী

চন্দ্রকোনা শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৩৮
Share:

চন্দ্রকোনায় লক্ষ্মী হাঁসদার বাড়ি।

ডাইন বলে কিছু নেই। ও সব ফালতু। দল নিয়ে সচেতনতা প্রচার গিয়ে এমনই বুঝিয়েছিলেন বিডিও।

Advertisement

পাল্টা কয়েকজন গ্রামবাসী-সহ মোড়ল বিডিওকে বলেছিলেন, “তোরা এ সবের কী বুঝবি। গ্রাম ছাড়লেই লক্ষ্মী ডাইনকে পেটানো হবে।’’ সচেতনতার এমনই হাল চন্দ্রকোনার নীলগঞ্জের সভোনা পাড়ায়। যাঁর জন্য বিডিও শাশ্বত প্রকাশ লাহিড়ী-সহ পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মঙ্গলবার সভোনা পাড়ায় ছুটতে হয়েছিল তিনি লক্ষ্মী হাঁসদা। বছর পঁয়ত্রিশের লক্ষ্মীকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়েছে প্রশাসন। সেই নিরাপদ জায়গা থেকে বুধবার ফোনে লক্ষ্মী বললেন, ‘‘আমি গ্রামে ফিরতে চাই। পরিশ্রম করে সংসার চলে। আত্মীয়ের ঘরে বসে কদিন খাব?’’

ঘরে ফিরতে চান লক্ষ্মী। কিন্তু সত্যিই কি সে পরিবেশ তৈরি হয়েছে? এ দিন গ্রামে ঘিরে যা দেখা গেল, তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট— দম বন্ধ করা পরিবেশ কাটেনি এখনও। এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান আদিবাসী মহিলা। বসনছড়া গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান সুতফা মান্ডির গলাতেও অসহায়তার স্বর। তিনি বললেন, “বিডিও সাহেব তো সব জানেন।” গ্রামের মাতব্বর পূর্ণ সরেন স্পষ্ট বললেন, “বোকারোর এক জানগুরু গণনা করে লক্ষ্মীর ভিতরে ডাইন দেখেছেন। তাই ওর ঘর থেকে দেবতাকে না সরালে লক্ষ্মীর রেহাই মিলবে না।”

Advertisement

ঘটনার সূত্রপাত মাস সাত আট আগে। সভোনা পাড়ার মাটি সরেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। বহু দিন রোগ না সারায় ঝাড়ফুঁক করাচ্ছিলেন মাটির বাড়ির লোকজন। তেমন চিকিৎসাও হয়নি। দিন কয়েক আগে বোকারোর এক জানগুরু লক্ষ্মী হাঁসদাকে ডাইন চিহ্নিত করে। এর পর থেকেই লক্ষ্মী ও তাঁর বাড়ির সদস্যদের একঘরে করা হয়। লক্ষ্মীর উপর শুরু হয় অত্যাচার। করা হয় জরিমানাও। খবর পেয়ে চন্দ্রকোনা-২ ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকেরা মঙ্গলবার গ্রামে যান। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে ভরসা পাননি প্রশাসনিক আধিকারিকেরা। তাই কুসংস্কার দূর করতে গ্রামে লাগাতার সচেতনতা শিবির করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। তার ফাঁকেই বিডিও শুনতে হয়েছিল, লক্ষ্মীকে পেটানোর হুঁশিয়ারি।

লক্ষ্মী তাঁর ভাই গণেশের সঙ্গেই থাকেন। লক্ষ্মী অবিবাহিত। রাজমিস্ত্রির জোগড়ের কাজ করে ভাইকে সাহায্য করে‌ন লক্ষ্মী। এ দিন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গণেশের আক্ষেপ, ‘‘বিনা কারণে দিদি ঘরছাড়া। আমরাও বয়কটের শিকার। কেউ কথাও বলেনি। এই ভাবে কী আর বাঁচা যায়?” লক্ষ্মীদের বাড়ির অদূরেই মাতব্বর পূর্ণ এবং বাবুলাল সরেনদের বাড়ি। বাবুলালের স্ত্রীই হলেন মাটি। যাঁর অসুস্থতা নিয়ে এত কাণ্ড সেই এখন বাড়িতে নেই। চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে খড়্গপুরে। বাড়ি লাগোয়া রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বাবুলাল বলছিলেন, “লক্ষ্মীর কুনজরে পড়ে বৌ অসুস্থ হয়ে গেল।”

আর পাঁচটা আদিবাসী পাড়ার চেয়ে কিছুটা এগিয়ে নীলগঞ্জের সভোনা পাড়া। মাটির পাশাপাশি রয়েছে অনেক পাকা বাড়িও। প্রাথমিক, আইসিডিএস স্কুল রয়েছে। বাসিন্দারা চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এ সব কিছুর পাশাপাশি রয়েছে ডাইনে বিশ্বাসও। বিডিও বললেন, “গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা হচ্ছে। পুলিশ নজরে রেখেছে। লাগাতার প্রচার করে কুসংস্কার দূর করতে হবে। আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে।” নিজস্ব চিত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement