প্রতীক্ষালয় প়ড়ে খড়্গপুরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, গাছতলাই ভরসা

বছর আশির প্রমীলা বাগের বাড়ি খড়্গপুর-২ নম্বর ব্লকের ভিতপুরে। বেশ কয়েক মাস ধরেই হাঁটুর যন্ত্রণায় ভুগছেন তিনি। মাস খানেক আগে নাতি দীপঙ্কর মণ্ডলের হাত ধরে বৃদ্ধা গিয়েছিলেন ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

খড়্গপুর শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৩০
Share:

বন্ধ পড়ে প্রতীক্ষালয়। —নিজস্ব চিত্র।

বছর আশির প্রমীলা বাগের বাড়ি খড়্গপুর-২ নম্বর ব্লকের ভিতপুরে। বেশ কয়েক মাস ধরেই হাঁটুর যন্ত্রণায় ভুগছেন তিনি। মাস খানেক আগে নাতি দীপঙ্কর মণ্ডলের হাত ধরে বৃদ্ধা গিয়েছিলেন ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে তখন লম্বা লাইন। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে পায়ে ব্যথা নিয়ে বৃদ্ধা দাঁড়াবেন কী করে! এ দিকে, বসার জায়গা বলতে আশপাশের কয়েকটি গাছতলা। কিন্তু সেখানে তিল ধারণের জায়গা নেই। অগত্যা যন্ত্রণা সহ্য করেই দাঁড়িয়ে থাকতে হল প্রমীলাদেবীকে। বৃদ্ধার নাতির ক্ষোভ, ‘‘এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশ্রামাগার নেই, নেই শৌচাগারও। সে দিকে কারও নজরও নেই।’’

Advertisement

পরিকাঠামো ছাড়াই রাজ্য জুড়ে একের পর এক সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিশ্রুতি, প্রত্যন্ত এলাকাতেও পৌঁছে দেবেন আধুনিক চিকিৎসা পরিষেবা। কিন্তু বাস্তব হল গাঁ-গঞ্জের মানুষের কাছে হাসপাতাল-স্বাস্থকেন্দ্রে যাওয়া মানেই এমন নানা ভোগান্তির মুখে পড়া।

খড়্গপুর ২ ব্লকের রাঙাদিঘির বাসিন্দা স্বাগতা রাউলের পরিজনদের অভিজ্ঞতাও সেই ভোগান্তিরই। প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। দু’বেলা বাড়ির লোকেদের যাতায়াত লেগেই ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশ্রামাগার না থাকায় গাছতলায় চাদর পেতে শুয়ে থাকা ছাড়া গতি ছিল না পরিজনদের। স্বাগতার বাবা অরুণ পাত্র বলেন, ‘‘ওই ক’টা দিন কী যে সমস্যার মধ্যে কেটেছে বলে বোঝানো যাবে না। বিশ্রামের জায়গা নেই, পানীয় জল নেই, শৌচালয় নেই। অবিলম্বে এই সব পরিকাঠামো গড়ে তোলা উচিত।’’

Advertisement

খড়্গপুর-২ ব্লকের চাঙ্গুয়ালে অবস্থিত এই ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগী ও তাঁদের পরিজনেদের অভিজ্ঞতা অল্পবিস্তর একই। অথচ ২০১৪ সালে এই স্বাস্থকেন্দ্র চত্বরে গড়ে তোলা হয় প্রতীক্ষালয়। নাম দেওয়া হয় ‘আরোগ্য নিকেতন প্রতীক্ষালয়’। খড়্গপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির তত্ত্বাবধানে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের বরাদ্দ করা ৭ লক্ষ ১২ হাজার টাকায় তৈরি সেই ভবন আজও চালু হয়নি আর প্রতীক্ষালয়ের সঙ্গে কোনও শৌচাগার তৈরিই করা হয়নি। প্রতীক্ষালয়ের ভবনটি পঞ্চায়েত সমিতি হস্তান্তরও করেনি বলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রের খবর। ফলে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা গাছতলাতেই ঠাঁই নিচ্ছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগী ও তাঁদের পরিজনেরা।

এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর চাঙ্গুয়াল, সাঁকোয়া, লছমাপুর, চকমকরামপুর-সহ ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ নির্ভরশীল। ১০টি শয্যার মধ্যে গড়ে ৮টি ভর্তি থাকে। এ ছাড়াও প্রতিদিন গড়ে একশো জন বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ৩০ শয্যায় উন্নীত করার কাজ চলছে। অথচ প্রতীক্ষালয়ের ভবন পড়ে থাকা সত্ত্বেও তা চালু না করায় ক্ষোভ বাড়ছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে পানীয় জলেরও কোনও বন্দোবস্ত নেই। বছর দুয়েক আগে একটি রিজার্ভার গড়া হয়েছিল। কিন্তু সেটিও আর চালু নেই।

এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা পরিষেবা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয়দের। অথচ ৩ জন চিকিৎসক ও ৫ জন নার্স রয়েছেন এই স্বাস্থ্যেকেন্দ্রে। চাঙ্গুয়ালের বাসিন্দা বিবেক ঘোষের ক্ষোভ, ‘‘চিকিৎসা পরিষেবা তথৈবচ। মানুষের দুর্ভোগ প্রতিকারের কোনও চেষ্টাই নেই।’’

লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণের পরেও প্রতীক্ষালয় চালু না হওয়ায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকেই বলছেন, লোক দেখাতে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের টাকায় ভবন নির্মাণ করে দায় সেরেছে পঞ্চায়েত সমিতি। কিন্তু পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। তাই বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে ‘আরোগ্য নিকেতন প্রতীক্ষালয়’। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক অভিরূপ সিংহ বলেন, ‘‘আমি নতুন এসেছি তাই সবটা জানা নেই। শুনেছি শৌচালয় না হওয়ায় এখনও প্রতীক্ষালয়ের ভবনটি আমাদের হস্তান্তর করা যায়নি। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসায় কোথাও গাফিলতি নেই।’’ পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরিশচন্দ্র বেরার বক্তব্য, ‘‘ওই প্রতীক্ষালয় যদি পঞ্চায়েত সমিতি গড়ে থাকে তবে ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’’

কী বলছে পঞ্চায়েত সমিতি?

পঞ্চায়েত সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নারায়ণ মাজির জবাব, ‘‘অর্থাভাবে শৌচাগার গড়া যায়নি। আর শৌচাগার ছাড়া ওই প্রতীক্ষালয় চালু করা যায়নি। তবে খুব শীঘ্রই আমরা চতুর্দশ অর্থ কমিশনের টাকায় ওই শৌচালয় গড়ব। সেই সঙ্গে জলের বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করা হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement