সুপারের সামনে বিক্ষোভ। (ইনসেটে) মণিমালা ভট্টাচার্য। —নিজস্ব চিত্র।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দিতে রাজ্যে একাধিক সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। উপযুক্ত পরিকাঠামো না গড়ে এই হাসপাতালগুলি চালু করে দেওয়ার অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। এ বার ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে চিকিৎসায় গাফিলতির দরুন মণিমালা ভট্টাচার্যের (৩২) মৃত্যুর অভিযোগ ঘিরে ফের তা একবার বেআব্রু হল।
রবিবার রাতে পেটে যন্ত্রণা নিয়ে ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হন মণিমালা ভট্টাচার্য। ঝাড়গ্রামের রঘুনাথপুরের বাসিন্দা মণিমালাদেবী দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মৃতার পরিজনেদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পাঁচ ঘণ্টা পরেও তাঁর কী হয়েছে, জানাতে পারেননি চিকিৎসকরা। রোগিণী দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কোনও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ দেখেননি। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা যথাযথ দায়িত্ব পালন না করায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার সকালে ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। দফায় দফায় হাসপাতাল সুপার মলয় আদককে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখানো হয়। এ দিন ঝাড়গ্রামের পুরপ্রধান দুর্গেশ মল্লদেব ও শহর তৃণমূলের সভাপতি প্রশান্ত রায়ও হাসপাতালে গিয়ে ঘটনার কারণ জানতে চান ।
রবিবার রাতে মণিমালাদেবীকে প্রথমে দেখেন মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসক দেবার্ঘ্য মণ্ডল। প্রথমে হজমের সমস্যাজনিত গ্যাসট্রাইটিসের চিকিৎসা শুরু হয়। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাঁকে অক্সিজেনও দেওয়া হয়। রাতে শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হলে তাঁকে ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের ‘ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট’ (সিসিইউ)-এ স্থানান্তর করা হয়।
সিসিইউ-তে কর্তব্যরত চিকিৎসক শুভঙ্কর গায়েন মণিমালাদেবীর স্বামী অশোক ভট্টাচার্যের কাছে জানতে চান, মণিমালাদেবীর ‘করোনারি হার্ট ডিজিজ’ আছে কি না। চিকিৎসক জানান, রোগিণীর হার্ট ব্লক হয়ে যাচ্ছে। অশোকবাবু স্ত্রীকে অন্যত্র নিয়ে যেতে চাইলে চিকিৎসক বলেন, রোগিনীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তাঁকে কোথাও সরানো যাবে না।
অভিযোগ, কিছুক্ষণ পরেই ফের ওই চিকিৎসক জানতে চান, মণিমালাদেবীকে সাপে কামড়েছে কি না। অশোকবাবুর দাবি, আমার স্ত্রীর হার্টের সমস্যা ছিল না। ওকে সাপেও কামড়ায়নি। বিষয়টি চিকিৎসককে জানাই। অশোকবাবুর দাবি, ‘‘সোমবার সকাল সওয়া ৫টা নাগাদ চিকিৎসক ফের ডেকে বলেন, স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ। যদি মৃত্যু হয়, তা হলে ময়না-তদন্ত করিয়ে নেবেন। আমি বলি আমার স্ত্রী জীবিত রয়েছেন, আপনি এ সব কী বলছেন। কিন্তু উনি আর কোনও কথা না বলে সিসিইউ-এ ঢুকে যান। সকাল ৬টা ২০ মিনিটে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়।’’
নিজের ভুলের কথা স্বীকার করছেন চিকিৎসক দেবার্ঘ্য মণ্ডল। তাঁর দাবি, “রোগিণী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন সেটা চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজে উল্লেখ করেছিলাম। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো দরকার সেটাও লিখেছিলাম। রোগিণীকে একবার দেখে চলে গিয়েছিলাম। এটা আমার ভুল হয়েছে।”
যদিও ‘অন্য’ কথা বলছেন চিকিৎসক শুভঙ্কর গায়েন। তাঁর দাবি, “রোগিণীর চিকিৎসা সংক্রান্ত যে নথি আমার কাছে এসেছিল, তাতে অন্তঃস্বত্ত্বার ব্যাপারে কোনও তথ্য ছিল না। সিসিইউ-তে রোগিণীকে যখন দেখি তখন কিছুই করার ছিল না।” মৃত্যুর আগেই ময়না তদন্তের কথা বললেন কেন? শুভঙ্করবাবু বলছেন, ‘‘কথাটা ও ভাবে বলতে চাইনি।’’
এই প্রসঙ্গে সিএমওএইচ অশ্বিনীবাবু বলেন, “ওই মহিলার চিকিৎসা সংক্রান্ত রিপোর্ট রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে পাঠিয়েছি। ভর্তি হওয়ার পর পাঁচ ঘণ্টা সময় পেলেও কেন ওই রোগিণীকে উপযুক্ত চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া গেল না, তা তদন্ত করে দেখা হবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কেন রোগিণী জীবিত থাকাকালীন ময়না তদন্তের কথা বলা হল, সেটাও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে জানতে চাওয়া হবে। পুরো বিষয়টি নিয়ে বিভাগীয় তদন্ত করা হচ্ছে।’’
হাসপাতাল সুপার মলয় আদকের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না-জানিয়ে রবিবার ছুটিতে যাওয়ার অভিযোগ ওঠায় স্বাস্থ্য দফতরের অস্বস্তি আরও বেড়েছে। কাউকে তিনি ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্বও দিয়ে যাননি বলে অভিযোগ। সোমবার মলয়বাবু বলেন, ‘‘সপ্তাহে ছ’দিন একটানা অফিস সামলে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাই একদিন বিশ্রাম নিই।” এ প্রসঙ্গে সিএমওএইচ অশ্বিনীবাবুর বক্তব্য, ‘‘ডিউটির সময় সমস্ত চিকিৎসকদের হাসপাতালে থাকতে হবে। সুপার কেন কাউকে না জানিয়ে ছুটিতে গিয়েছিলেন, সে বিষয়ে তাঁর কাছে কৈফিয়ত তলব করা হবে।”
এ দিন ঝাড়গ্রামের পুলিশ মর্গে মণিমালাদেবীর ময়না তদন্ত করা হয়। ময়না তদন্ত চলাকালীন ভিডিওগ্রাফি করা হয়। হাসপাতাল সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে ময়না তদন্তে জানা গিয়েছে, মণিমালাদেবীর তলপেটে রক্তক্ষরণের কারণেই মৃত্যু হয়েছে।