বক্তা সুব্রত মুখোপাধ্যায়। মঞ্চে রয়েছেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, মানস ভুঁইয়ারা। সবংয়ে, আশির দশকের এক সভায়।
‘না ফেরার দেশে’ চলে গিয়েছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গ রাজনীতিতে নক্ষত্রপতন হয়েছে। বর্ণময় ব্যক্তিত্ব সুব্রত। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— বারবার সামলেছেন মন্ত্রিত্বের গুরুদায়িত্ব। বারবার এসেছেন মেদিনীপুরে। এ বারও পুজোর আগে ঘাটালে এসেছিলেন বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে। তাঁর প্রয়াণে স্মৃতিকাতর পশ্চিম মেদিনীপুরের মানস ভুঁইয়া, দীনেন রায়রা।
জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা সবংয়ের বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলছিলেন, ‘‘সুব্রত মুখোপাধ্যায় তো আমার জীবনের একটা বড় অংশ। ১৯৬৯ সালে এনআরএসের ফার্স্ট ইয়ারে যখন আসি তখন প্রিয়দা সভাপতি, সুব্রতদা সহ-সভাপতি ছাত্র পরিষদের। নকশালদের রাজত্ব।’’ সেই সময়ে এনআরএসে ছাত্র পরিষদের ইউনিটের কনভেনর হয়েছিলেন মানস। তাঁর কথায়, ‘‘দিনটা আমার এখনও মনে আছে। ১৭ সেপ্টেম্বর, বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে প্রিয়দা, সুব্রতদার হাত থেকে ছাত্র পরিষদের পতাকা নিয়েছিলাম।’’ মানসের ডাকে অনেকবার সবংয়ে এসেছেন সুব্রত। মানস বলছিলেন, ‘‘১৯৮১ সাল। আমি তখনও বিধায়ক হইনি। মোটরবাইকে চড়ে সারতা অঞ্চলে আদাসিমলা স্কুল মাঠে এসেছিলেন সুব্রতদা। একটি মেয়েকে সাতজন মিলে গণধর্ষণ করেছিল মেরে দিয়েছিল। তার প্রতিবাদে সভা হয়েছিল।’’ মানস বলছিলেন, ‘‘প্রিয়দা সেই সময়ে ইন্দিরা গাঁধীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। প্রিয়দার অবর্তমানে সবটাই দেখাশোনা করতেন সুব্রতদা। আমরা প্রিয়দা-সুব্রতদার টিমের ছাত্র-যুব রাজনীতি করা মানুষ। যে কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতেন স্ফুলিঙ্গের মতো।’’
বৃহস্পতিবার দুপুরে স্ত্রী গীতারানিকে নিয়ে এসএসকেএমে গিয়ে সুব্রতর সঙ্গে দেখা করেছিলেন মানস। মানসের কথায়, ‘‘দুপুরে দেখা হল, কথা হল, রাতে খবর পেলাম সুব্রতদা আর নেই। ভাবতেও পারছি না।’’ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মানসের ভাই বিকাশ ভুঁইয়া বলছিলেন, ‘‘১৯৮০ সাল। আমাকে একটি মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কলকাতায় গিয়ে তখন সুব্রতদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। মাস তিনেক ছিলাম। সব সময় সাহায্য, পরামর্শ পেয়েছি। সুব্রতদা আমাকে ইন্দিরা- কংগ্রেসের সবং ব্লকের কনভেনর করেছিলেন।’’
শোকবিহ্বল তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান তথা খড়্গপুরের (গ্রামীণ) বিধায়ক দীনেন রায়ও। বলছিলেন, ‘‘১৯৬৯ সালে প্রথম পরিচয়। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। পরে বঙ্গবাসী কলেজ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ক্যান্টিনে দেখা হত। তখন ছাত্র-যুবরাই কংগ্রেস চালাত। কলকাতার রাস্তায়, মেদিনীপুরে, ট্রেনে বাসে কংগ্রেসের পত্রিকা ‘বাংলার কথা’ বিক্রি করেছি। দাম ছিল চার আনা। সুব্রতদা সব সময়ে বলতেন, ‘ভয় পাবি না’। তুখোড় বাগ্মী ছিলেন।’’ দীনেন বলছিলেন, ‘‘মেদিনীপুরেও অনেকবার এসেছেন। সুব্রতদা, প্রিয়দারা তখন খড়্গপুর পর্যন্ত ট্রেনে আসতেন। তারপরে বাসে করে মেদিনীপুরে আসতেন। মেদিনীপুরের বড়বাজারে কংগ্রেস অফিসে খবরের কাগজে মুড়ি চপ রেখে খেতে খেতে কর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। বাংলার রাজনীতি ওঁর অভাব অনুভব করবে।’’
গত মাসেও ঘাটালে এসেছিলেন বন্যা পরিস্থিতি দেখতে।
সুব্রত যখন ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি, তখন ওই সংগঠনের রাজ্য সহ-সভাপতি সমীর রায়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের সভাপতি সমীর বলছিলেন, ‘‘কংগ্রেসের অনেকের মতো আমারও রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্র পরিষদে। মেদিনীপুর কলেজ থেকে হাওড়ায় নরসিংহ দত্ত কলেজ। আমি হাওড়া জেলা ছাত্র পরিষদের সভাপতি হলাম। তারপর মহাজাতি সদনের দোতলায় যাতায়াত শুরু আর সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়। প্রিয়দার পরে ছাত্র পরিষদের সভাপতি হল সুব্রত। সহ-সভাপতি তিনজন। আমি, বর্ধমানের নুরুল ইসলাম, মালদার গৌতম চক্রবর্তী।’’
সে সবই এখন স্মৃতি। মানসরা বলছেন, ‘‘লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে চিরদিন থাকবেন সুব্রতদা।’’