লড়াই দুই বিদায়ী বিধায়কের। একজন পিংলার বিদায়ী বিধায়ক। অন্যজন তমলুকের খাসতালুক ছেড়ে এ বার নয়া চ্যালেঞ্জের মুখে।
যুযুধান দুই প্রার্থীর একজন ডিএসপি-র প্রবোধচন্দ্র সিনহা গত বিধানসভা ভোটে প্রথমবার পিংলায় প্রার্থী হন। জিতেও যান। অন্যজন সৌমেন মহাপাত্র তমলুকের বিদায়ী বিধায়ক। এ বার শুধু কেন্দ্র বদল নয়, জেলা বদল হয়েছে বিদায়ী জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর। নতুন কেন্দ্রে দলের কোন্দল সামলে জয় পাওয়াই সৌমেনবাবুর কাছে চ্যালেঞ্জ।
লড়াইয়ের ময়দানে তাল ঠুকছেন পিংলার বিজেপি প্রার্থী তথা প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি অন্তরা ভট্টাচার্যও। বাম রাজনীতির হাত ধরেই তাঁর উত্থান। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি দল বদলে বিজেপিতে আসেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের ধারণা, পিংলায় অন্তরাদেবীর ভাল পরিচিতি রয়েছে। ভোটে তার একটা প্রভাব পড়বেই। যদিও এলাকায় বিজেপির সংগঠন ন়ড়বড়ে হওয়ায় কিছুটা হলেও চাপে রয়েছেন অন্তরাদেবী।
১৯৭৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার বিধায়ক ছিলেন প্রবোধবাবু। ২০০৬ সালে ওই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী শিশির অধিকারীর কাছে তিনি পরাজিত হন। ২০০৯ সালের উপ নির্বাচনে ফের এগরা থেকেই ভোটে লড়েন তিনি। যদিও তৃণমূলের সমরেশ দাসের কাছে প্রবোধবাবু হেরে যান। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে জেলা বদলে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হন। এ বারও ওই কেন্দ্র থেকেই লড়ছেন তিনি।
গত বছর পরিবর্তনের প্রবল হাওয়াতেও জয়ী হয়েছিলেন প্রবোধবাবু। যদিও তাঁর জয়ের পথে অন্যতম বাধা ‘বহিরাগত’ কাঁটা। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক প্রবোধবাবু পিংলার বাসিন্দা নন। প্রয়োজনে তাঁকে এলাকায় পাওয়া যায় না। এমনকী সামান্য শংসাপত্র পেতেও সমস্যা হয়।
যদিও প্রবোধবাবুর দাবি, এলাকাবাসীর যে কোনও সমস্যায় তিনি পাশেই রয়েছেন। গত পাঁচ বছরে স্থানীয়দের বিভিন্ন বিষয়ে কয়েক হাজার শংসাপত্র দিয়েছেন তিনি। প্রবোধবাবু বলছেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে যে ভাবে টাকা লুঠ হয়েছে, ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গিয়েছে, তারপরে মানুষ আর তৃণমূলকে চাইছে না। গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ জোটের প্রার্থী হিসেবে আমার জয় নিশ্চিত।’’
ভোট সমীকরণ কী বলছে? গত বিধানসভা ভোটে প্রবোধবাবু মাত্র ১২৩৪টি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। ৪৭.২৪ শতাংশ ভোট ছিল তাঁর দখলে। তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের দখলে ছিল ৪৬.৫৬ শতাংশ ভোট। বিজেপি পেয়েছিল ৪.২৬ শতাংশ ভোট। গত লোকসভা ভোটে বামেদের ভোট শতাংশ প্রায় ১৪ শতাংশ কমে হয় ৩৩.৭৭ শতাংশ। তৃণমূলের ভোট শতাংশ সামান্য বেড়ে হয় ৪৬.৯৪ শতাংশ। কংগ্রেস ও বিজেপির দখলে ছিল যথাক্রমে ৮.০২ ও ৮.২৫ শতাংশ ভোট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বামেরা হারানো ভোট কতটা ফিরে পায়, সেটাই দেখার বিষয়।
পিংলা বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পিংলা ব্লকের ৭টি অঞ্চল ও খড়্গপুর-২ ব্লকের ৯টি অঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে খড়্গপুর-২ ব্লকে কংগ্রেসের সংগঠন দুর্বল। ফলে ওই এলাকায় বাজিমাত করতে বাম ভোটের উপরই বেশি ভরসা করতে হবে প্রবোধবাবুকে। তৃণমূলের এক সূত্রে খবর, পিংলা থেকে নির্বাচিত জেলা পরিষদ সদস্য অজিত মাইতি এ বার ওই কেন্দ্র থেকে ভোটে লড়ার অন্যতম দাবিদার ছিলেন। খড়্গপুর-২ ব্লকের বাসিন্দা অজিতবাবুর এলাকায় ভাল প্রভাব রয়েছে। প্রথমদিকে সৌমেনবাবুর কোনও বৈঠকেই অজিতবাবুকে দেখা যাচ্ছিল না। আপাত ভাবে সব মিটে গিয়েছে বলে মনে হলেও ভোটে অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে বলে দলের এক সূত্রে খবর।
খড়্গপুর-২ ব্লকের লছমাপুরের বাসিন্দা যুবক কার্তিকচন্দ্র দোলই সৌমেনবাবুর বিরুদ্ধে নির্দল হিসেবে লড়ছেন। দলীয় সূত্রে খবর, এলাকায় তৃণমূল নেতা হিসেবে পরিচিত কার্তিক একসময়ে অজিতবাবুরও ‘ঘনিষ্ঠ’ ছিলেন। নির্দল প্রার্থী কার্তিক বলছেন, “আমাদের এখানে দলের কোনও নেতা কাজের নয়। তবে সাংগঠনিক দিক থেকে অজিতবাবু তুলনায় ভাল।” এ বার ভোটে অজিতবাবু প্রার্থী হলে কি তার জয়ের সম্ভাবনা ছিল? কার্তিক বলছেন, “অজিতবাবু যদি কাজের মানুষ হতেন, তবে বিগত দিনে হারতেন না।” তাহলে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন ভোট লড়ছেন? তাঁর উত্তর, ‘‘আমি বেকার। এত বছরে রাজ্যে একটাও শিল্প হয়নি, কর্মসংস্থান হয়নি। এ সবের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই আমি প্রার্থী হয়েছি।’’ তিনি বলছেন, ‘‘মানুষের আশীর্বাদে জয়ের আশাও দেখছি। আর জয় না পেলেও অন্তত তৃণমূলকে তো ধাক্কা দিতে পারব।’’
গুরুত্ব না দিয়ে সৌমেনবাবু বলছেন, “আমি পিংলায় প্রার্থী হয়েছি বলে কারও ক্ষোভ থাকতেই পারে। এ ছাড়া আমার কোনও ‘মাইনাস পয়েন্ট’ নেই।’’ পিংলার তৃণমূল প্রার্থীর বক্তব্য, ‘‘আমি পিংলার ভূমিপুত্র। পিংলা কলেজে শিক্ষকতা করেছি। এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার পরিচিতি রয়েছে। মানুষ আমাকেই চাইছে।”
জয় নিয়ে আশাবাদী বিজেপি প্রার্থী অন্তরাদেবীও। তিনি বলছেন, “পিংলায় আমাদের সংগঠন হয়তো শক্তিশালী নয়। তবে আমি পিংলার বাসিন্দা। বিগত পাঁচ বছর উন্নয়ন থমকে রয়েছে। এলাকার মানুষ সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় বিধায়কেরও বদল চাইছেন।”