প্যারাসেলিং দুর্ঘটনা

সৈকতের বাতিস্তম্ভ নিয়ে উঠছে প্রশ্ন

সৌন্দর্যায়নের নামে মন্দারমণিতে নানা রকম কাজ চলছে বহু দিন। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পরিবেশবিদ সকলেই তা নিয়ে বেশ চিন্তিত। এমনকী জুন মাসের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার অনেক আগে সৈকতে দীর্ঘদেহী হাইমাস্ট আলো বসানো নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন হোটেল মালিকদের সংগঠন।

Advertisement

সুব্রত গুহ

মন্দারমণি শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০১:০৪
Share:

এ রকম খুঁটি উপড়েই মন্দারমণিতে ঘটেছিল দুর্ঘটনা। — নিজস্ব চিত্র।

সৌন্দর্যায়নের নামে মন্দারমণিতে নানা রকম কাজ চলছে বহু দিন। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পরিবেশবিদ সকলেই তা নিয়ে বেশ চিন্তিত। এমনকী জুন মাসের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার অনেক আগে সৈকতে দীর্ঘদেহী হাইমাস্ট আলো বসানো নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন হোটেল মালিকদের সংগঠন।

Advertisement

‘মন্দারমণি সি-বিচ হোটেলিয়ার্স ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক দেবদুলাল দাসমহাপাত্রের দাবি তিনি মার্চ মাসেই প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন এ ভাবে সৈকতে উঁচু বাতিস্তম্ভ লাগানোর কাজ ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু কর্ণপাত করেনি প্রশাসন।

দেবদুলালবাবুর প্রশ্ন, “গাড়ির একটা হ্যাঁচকা টানে প্যারাশ্যুটের দড়ি ছিঁড়ল বা কাপড় ছিঁড়ল না। অথচ গোটা বাতিস্তম্ভটাই উপড়ে গেল! আশ্চর্য বিষয় এ নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করল না প্রশাসন।’’ একই প্রশ্ন মন্দারমণির বাসিন্দাদেরও। এমনকী প্রশ্ন তুলছেন পঞ্চায়েত সদস্যরাও।

Advertisement

রামনগর-২ পঞ্চায়েত সমিতির স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য প্রদীপ কুমার সাউয়ের অভিযোগ, “জিপে লাগানো দড়ির টানে গোটা বাতিস্তম্ভ উপড়ে পড়ার ঘটনাটাই যথেষ্ট। আলাদা করে বোঝাতে হবে না কতটা নিম্নমানের কাজ হয়েছে। দুর্ভাগ্য একটি মর্মান্তিক মৃত্যু এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল।’’

মন্দারমণির হোটেল মালিকদের বক্তব্য, সৈকত সৌন্দর্যায়নের নামে রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের মাধ্যমে মন্দারমণিতে হাইমাস্ট আলোকস্তম্ভ বসানোর কাজ করছে প্রশাসন। প্রস্তাবিত ১৪টি স্তম্ভের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ৮টি বসানো হয়ে গিয়েছে। তবে সেগুলির উদ্বোধন হয়নি। অভিযোগ বাতিস্তম্ভ বসানোর কাজে নিযুক্ত ঠিকাদারি সংস্থা অতি নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করছে।

তাঁদের অভিযোগ, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের ফলেই ২০মিটার উঁচু কমজোরি ওই বাতিস্তম্ভটি ২১ জুন প্যারাশ্যুটের দড়ির টানে উপড়ে পড়ে। দেবদুলালবাবুর অভিযোগ প্রায় ৬০ ফুট উচ্চতার বাতিস্তম্ভ গুলি বসাতে মাটিতে যতটা গভীর ভিতের প্রয়োজন তা না করে মাত্র তিন-চার ফুট গভীরে কংক্রীটের ঢালাই করা হয়েছে এখানে। তার উপর নাট বোল্টের সাহায্যে আটকে দেওয়া হয়েছে ওই ৬০ফুট উঁচু স্তম্ভ।

তাঁর অভিযোগ, শুধু দড়ির টান কেন, জোর সামুদ্রিক বাতাস লাগলেই ও গুলি দুলতে থাকে। বড় কোনও সামুদ্রিক ঝড় ঝঞ্ঝা হলেই লাইটপোস্ট গুলি উপড়ে পড়ার সম্ভাবনা।

সমুদ্রবিজ্ঞানী ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় এক সময় ছিলেন দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান। তিনি কিন্তু স্পষ্ট জানিয়েছেন মন্দারমণির সৈকত এত উঁচু বাতিস্তম্ভ লাগানোর উপযুক্ত নয়। কোস্টাল রেগুলেটিং জোন অথরিটি-র আইন অনুযায়ীও এমনটা করা যায় না। এই বেলাভূমির এমন ক্ষমতা নেই যে এ ধরনের নির্মান ধারণ করে। তা ছাড়া, মন্দারমণি সৈকতের অবস্থা এতটাই খারাপ যে বালি সরে গিয়ে কাদা-জল বেরিয়ে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়।

দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদও স্বীকার করেছে ইতিমধ্যেই কমজোরি বাতিস্তম্ভ বসানো নিয়ে স্থানীয় কিছু মানুষ অভিযোগ জানিয়েছেন। যদিও পর্ষদ এ বিষয়ে তাদের দায় ঝেড়ে ফেলেছে। তাদের বক্তব্য, পর্যটন দফতরের বরাদ্দ টাকায় মন্দারমণি সৈকত সৌন্দর্যায়নের জন্য ওই বাতিস্তম্ভ বসানোর কাজ করছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম। কাজ শেষ হওয়ার পরে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্ষদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা। এর বেশি কিছু নয়। এমনকী সে দায়িত্ব এখনও পায়নি পর্ষদ।

এ দিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম সূত্রে জানা গিয়েছে, মন্দারমণি সৈকতে বাতিস্তম্ভ বসানোর জন্য সাত লক্ষ টাকা দর দিয়ে বরাত পেয়েছে একটি নামজাদা বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের কোম্পানি। আটটি স্তম্ভ বসানোর জন্য ৫৬ লক্ষ টাকারও বেশি টাকায় তারা কাজের বরাত পেয়েছে। ইতিমধ্যেই সেই আটটি স্তম্ভ তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।

গত ২১ জুন মন্দারমণির সৈকতে ‘বেঙ্গল অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস’ নামে একটি সংস্থা সৈকতে প্যারাসেলিং করার সময় প্যারাশ্যুটের কাপড় বাতিস্তম্ভে জড়িয়ে স্তম্ভটিই ভেঙে পড়ে, মৃত্যু হয় এক পর্যটকের। নিগমের সহকারি বাস্তুকার অভিজিৎ কর অবশ্য জানান, মৃতের পরিবারের তরফে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল তাতে বাতিস্তম্ভের নিম্নমান নিয়ে কোনও কিছু বলা নেই।

এ দিকে বাতিস্তম্ভ নিয়ে অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন নিগমের রিজিওনাল ম্যানেজার শ্রীনিবাস রাউত। কিন্তু তিনি নিম্নমানের কাজের কথা অস্বীকার করে বলেন, “বাতিস্তম্ভ বসানোর জন্য নামজাদা এক কোম্পানি দায়িত্ব পেয়েছে, সারা ভারতে তাদের কাজের সুনাম আছে। তা ছাড়া টেন্ডারে দেওয়া নিয়ম ও শর্তাবলী মেনেই তারা কাজ করেছে।’’ তাঁর বক্তব্য যন্ত্রচালিতগাড়ি দিয়ে টানার ফলেই ওই স্তম্ভটি উপড়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে নিম্নমানের কোনও সম্পর্ক নেই।

রিজিওনাল ম্যানেজার বা নিগম যাই বলুক না কেন, মন্দারমণির স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘আগামীদিনে ফের এ ধরনের কোনও বড় দুর্ঘটনা না ঘটলে কা হবে? তখন কি হুঁশ ফিরবে বিদ্যুৎ দফতরের? যেমন ২১ জুনের দুর্ঘটনার আগে সৈকতে অবৈধ প্যারাসেলিং বন্ধ করার বিষয়ে কোনও উদ্যোগ ছিল না পুলিশ ও প্রশাসনের।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement