রং-তুলি দিয়েই দেওয়া হচ্ছে আলপনা। কোলাঘাটের দেড়িয়াচকে। —নিজস্ব চিত্র।
চালের গুঁড়ো জলে ভিজিয়ে তা দিয়ে ঘরের মেঝেতে হাতের নিখুঁত টানে আঁকা ধানের শিষ, গাছ কৌটো, শঙ্খ-পদ্ম-চক্র, পেঁচা, লতা-পাতা আর মা লক্ষ্মীর পা। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন অসম্পূর্ণ এই আলপনা ছাড়া।
সময় বদলের সঙ্গে সেই আলপনাতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। চাল গুঁড়ো বা খড়িমাটির বদলে রঙ-তুলিতে আঁকা হচ্ছে আলপনা। অনেকে আবার বাজার থেকে কেনা স্টিকার লাগানো আলপনায় কাজ চালাচ্ছেন। সময় এবং ধৈর্যের অভাব যেমন এর জন্য দায়ী, তেমনই ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যাওয়ার অনীহা, যত্ন নিয়ে আলপনা আঁকার প্রক্রিয়া অগ্রজদের থেকে শিখে নেওয়ার ব্যাপারে উদাসীনতাও এর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রচলিত বিশ্বাস, লক্ষ্মীপুজোর রাতে মা লক্ষ্মী সবার অলক্ষ্যে গৃহস্থের চৌকাঠ পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেন। তাই তাঁকে স্বাগত জানাতে বাড়ির চৌকাঠ ও দরজার সামনে আঁকা হয় আলপনা। চৌকাঠ থেকে ঘট বা প্রতিমার কাছ পর্যন্ত মা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন এঁকে দেন বাড়ির মা-কাকিমারা।পুজোর জায়গা, লক্ষ্মী বসার কাঠের পিঁড়ি—সবই আলপনা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়।
আলপনা একটি অনবদ্য শিল্প। সৃষ্টিশীলতা, নান্দনিক বোধের মিশ্রণ থাকে এতে। আলপনা শিল্পী হিসেবে খ্যাতি রয়েছে তমলুকের রানিচক বেণীমাধব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কার্তিক সাহুর। লক্ষ্মীপুজোর সময় নিজের বাড়ির পাশাপাশি প্রতিবেশী ও পরিচিত অনেকের বাড়িতে আলপনা আঁকেন তিনি। তাঁর কথায়,"আলপনা অপরূপ এক শিল্প কর্ম। বাড়ির মা-কাকিমারা অনেকেই আগে এটা জানতেন। এখন বাড়িতে তেমন লোক পাওয়া মুশকিল হয়। তবে আলপনা আঁকার জন্য এখন নানা ধরনের রঙ পাওয়া যায়। তুলোর বদলে তুলির ব্যবহার করা হয়। তাতে আঁকা আরও সুন্দর হয়।"
বর্তমানে অধিকাংশ বাড়ির মেঝে পাকা সিমেন্টের। রঙিন টাইলসও বসানো। তাতে আলপনার দুধ সাদা রঙ তেমন ফোটে না, যেমন আগে ফুটত লাল মাটির মেঝেতে। তাই এখন রঙের সাহায্যেও আলপনা দেওয়া হচ্ছে। যদিও আলপনায় মূলত সাদা রঙই ব্যবহার করা হয়। রঙ দিলে আলপনা বেশি দিন টিকে যায়। কেউ কেউ আবার এখন স্টিকারের সাহায্যেও আলপনা দিয়ে থাকেন। তাতে ঐতিহ্য বা নিজস্ব শিল্পসত্ত্বার নামগন্ধ থাকে না।
সম্প্রতি অনেকে আবার পুরনো কৃষ্টি বা ঐতিহ্য ফেরানোর ব্যাপারে মন দিয়েছেন। তাঁদের অনেকে আলপনাকে নতুন করে জনপ্রিয় করার নানারকম পন্থা অনুসরণ করছেন। আলপনা প্রতিযোগিতা হচ্ছে। জামাকাপড়-শাড়িতে আলপনা আনা হচ্ছে। সমাজমাধ্যমে আলপনা এঁকে ছবি পোস্ট করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। জেলার কিছু কিছু জায়গায় আবার লক্ষ্মীপুজোয় আলপনা দেওয়ার প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে।
ড়িশা গ্রামের রুমকী দত্ত যেমন বলেন, ‘‘আমি আগে খড়িমাটি ব্যবহার করতাম আলপনায়। এখন বাজারে বিভিন্ন ধরনের রং পাওয়া যায়। সেগুলো দিয়েই আলপনা দিই। প্রতিমা বা ঘটের সামনের আলপনা বেশি দিন রাখতে নেই। ওতে পা-ও দিতে নেই। আলপনা ছাড়া মা লক্ষ্মীর পুজো কল্পনা করা যায় না।"