বৈঠকের পরে খড়্গপুরের বিরোধী দলের নেতারা। —নিজস্ব চিত্র।
বিজেপি কাউন্সিলরের স্বামীকে লক্ষ করে গুলি চলার ঘটনার প্রতিবাদে রেলশহরে এ বার এক জোট হল বিরোধীরা। সোমবার খড়্গপুরের রামমন্দিরে রীতিমতো বৈঠক করে কংগ্রেস, বাম ও বিজেপির শহর নেতৃত্ব রেলশহরে দুষ্কৃতী তাণ্ডব ঠেকানোর বার্তা দিয়েছেন। আজ, মঙ্গলবার ১২ ঘণ্টার খড়্গপুর বন্ধ ডেকেছে বিরোধীরা।
পুরবোর্ড গঠনের প্রাক্কালে খড়্গপুরে বিরোধীদের এই একজোট হওয়া ঘিরে স্বভাবতই জল্পনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের প্রশ্ন, তবে কি তৃণমূলকে ঠেকাতে খড়্গপুরেও দেখা যাবে রামধনু জোট? তৃণমূলের শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরীরও মত, ‘‘খড়্গপুরে আগেও অনেক অপরাধ হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলিকে জোট বাঁধতে দেখা যায়নি। পুরবোর্ডের দিকে তাকিয়েই তৃণমূলকে রুখতে এই জোট হয়েছে।’’ কংগ্রেস, বিজেপি ও বাম নেতৃত্ব অবশ্য বলছেন, খড়্গপুরে দুষ্কৃতীরাজের বিরুদ্ধেই তাঁরা একজোট হয়ে বন্ধ ডেকেছেন। পুরবোর্ড গঠনের সমীকরণের সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই। বিজেপির পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের কাউন্সিলরের স্বামীর উপর হামলা হয়েছে। হুমকি দেওয়া হচ্ছে ফোনে। তাই খড়্গপুরকে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। বোর্ড গঠন আলাদা বিষয়।’’ এই ‘অরাজনৈতিক বন্ধ’ যাতে তৃণমূলও সমর্থন করে, সেই আহ্বানও জানিয়েছেন তুষারবাবু। বিজেপির খড়্গপুর শহর সভাপতি প্রেমচাঁদ ঝা বলেন, ‘‘বোর্ড গঠনে মরিয়া তৃণমূল দুষ্কৃতী ও পুলিশের সাহায্য নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি করছে। রাজু গুপ্তের উপরে হামলার প্রতিবাদে বন্ধ ডাকব বলে আমরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পাশে দাঁড়িয়েছে বাম ও কংগ্রেস।’’ জেলার কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ারও বক্তব্য, পুরবোর্ড গঠন অন্য সমীকরণ।
খড়্গপুরে পুরবোর্ড গঠন ৪ জুন। এ বার শহরে পুরভোটের ফল হয়েছে ত্রিশঙ্কু। ১১টি করে আসন পেয়েছে কংগ্রেস ও তৃণমূল। বিজেপি ৭টি ও বামেরা ৬টি আসনে জয়ী হয়েছে। বোর্ড গড়তে ইতিমধ্যেই বামেদের সমর্থন চেয়েছে কংগ্রেস। তবে বোর্ড গঠনে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তৃণমূলও। হুমকি দিয়ে, মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে বিরোধী কাউন্সিলরদের ভাঙানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ। সেই লক্ষ্যেই ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর সুনীতা গুপ্তের স্বামী রাজুর উপর রবিবার হামলা হয় বলে অভিযোগ। তাঁকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া হয়। তবে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তিনি বেঁচে গিয়েছেন। এই ঘটনায় প্রকাশ মান্না ওরফে হোন্দল-সহ ৪ জনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। হোন্দল তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী বলেই অভিযোগ। ঘটনায় কেউই গ্রেফতার হয়নি।
এই ঘটনার পরেই রেলশহরে জোট বেঁধেছে বিরোধী দলগুলি। রবিবারই থানায় গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কংগ্রেস, বিজেপি ও বাম কাউন্সিলররা। তারপর এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ তিন দলের নেতারা বৈঠকে বসেন। ছিলেন বিজেপির শহর সভাপতি প্রেমচাঁদ ঝা, কংগ্রেসের শহর সভাপতি অমল দাস, সিপিএমের জোনাল সম্পাদক অনিতবরণ মণ্ডল, সিপিআই জেলা নেতা বিপ্লব ভট্ট প্রমুখ। বিভিন্ন দলের কয়েকজন কাউন্সিলরও ছিলেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের তরফে শহরে দুষ্কৃতী মোকাবিলায় লাগাতার কর্মসূচির প্রস্তাব দেওয়া হয়। কংগ্রেসের অমলবাবুর বক্তব্য, ‘‘রবিবারের ঘটনার পরে সব রাজনৈতিক দল এক হলেও তৃণমূলের কেউ থানায় যায়নি। এতেই প্রমাণ হয়ে যায় কারা এই কাজ করেছে।’’ সিপিএম নেতা অনিতবরণবাবু সুর চড়িয়ে বলেন, ‘‘তৃণমূল ভাবছে শহরকে বিরোধী শূন্য করবে। সে জন্যই ভারতী ঘোষকে পুলিশ সুপার করে রাখা হয়েছে।’’ এ দিন বৈঠক চলাকালীনও রাজু গুপ্তের কাছে হুমকি-ফোন আসে বলে অভিযোগ। ওই নম্বর থেকেই আবার বৈঠক শেষে বিজেপির শহর সভাপতি প্রেমচাঁদকে হুমকি দেওয়া হয়। বিজেপির তরফে থানায় অভিযোগও জানানো হয়। এরপরই সব বিরোধী দল একজোট হয়ে বন্ধ ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। আজ, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে ১২ ঘন্টার এই বন্ধ ডাকা হয়েছে।
খড়্গপুরে এ বার বামেদের সমর্থনে কংগ্রেসের বোর্ড গড়ার সম্ভাবনাই উজ্জ্বল। তবে স্থানীয় সূত্রে খবর, বেলরানি অধিকারী, জগদম্বাপ্রসাদ গুপ্ত ও সুখরাজ কৌরের মতো কয়েক জন বিজেপি কাউন্সিলরও কংগ্রেসকে বাইরে থেকে সমর্থন করতে পারে। বেলারানিদেবী বলেন, ‘‘তৃণমূলকে আমরা সমর্থন করব না। আর কাউকে সমর্থন করা হবে কি না সেটা নেতৃত্বের দেখার বিষয়।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি তুষারবাবু অবশ্য বলছেন, ‘‘আমাদের কোনও দল প্রস্তাব দেয়নি। তাই বোর্ড গঠনে আমাদের জয়ী প্রার্থীরা অনুপস্থিত থাকতে পারেন।’’
দুষ্কৃতী তাণ্ডবের প্রতিবাদে সম্মিলিত ভাবে বন্ধ ডাকার মধ্যে রাজনীতি দেখছেন না বিদায়ী পুরপ্রধান কংগ্রেসের রবিশঙ্কর পাণ্ডেও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি মনে করি আগে খড়্গপুর, তারপরে রাজনীতি। যা পরিস্থিতি তাতে শহরের ১৭ জন মহিলা কাউন্সিলরের নিরাপত্তা কে দেবে সেটাই বড় প্রশ্ন।’’ আর পুরসভা দখল ঘিরে রবিশঙ্করের বক্তব্য, ‘‘সবাই যখন বলছে তখন আমরাও বোর্ড গঠন করব বলেই ভাবছি। আমাদের দলীয় কাউন্সিলরদের বাইরেও অনেকের সমর্থন পাব বলে আশা করছি।’’