সাগরে পৌঁছল হোগলার নৌকা। নিজস্ব চিত্র
হাতে মাত্র ক’টা দিন। তার পরেই মকর সংক্রান্তির পূণ্যস্নান গঙ্গাসাগরে। এই উপলক্ষে সাগরে প্রতি বছর ভিড় করেন লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থী। তাঁদের জন্য সরকারি উদ্যোগে তৈরি হয় অসংখ্য হোগলা পাতার অস্থায়ী শিবির। সেই শিবিরে হোগলার চাদর তৈরিতে ব্যস্ত কোলাঘাটের নগুরিয়া গ্রাম।
কোলাঘাটের ওই গ্রাম থেকে গঙ্গাসাগরের অস্থায়ী শিবিরের জন্য হোগলার চাদর সরবরাহের রীতি চলে আসছে বহু বছর ধরে। প্রতি বছর কার্তিক থেকে নগুরিয়ার গ্রামবাসী ব্যস্ত হয়ে পড়েন হোগলার চাদর তৈরি করতে। স্থানীয় সূত্রের খবর, মূলত তমলুক ব্লক এলাকার রূপনারায়ণের চরে জন্মায় হোগলা ঘাস। কার্তিক মাসের প্রথম দিকে সেগুলি কাটা হয়। প্রয়োজন মতো পাতা কিনে আনেন নগুরিয়া গ্রামের ব্যবসায়ীরা। তা থেকেই তৈরি হয় দু’টি আকারে হোগলার চাদর। মকর সংক্রান্তির বেশ কিছুদিন আগেই সেগুলি নৌকোয় করে পাঠানো হয় গঙ্গাসাগরে।
নগুরিয়া গ্রামের প্রায় ৩০০ গ্রামবাসী হোগলার চাদর তৈরির কাজ করেন। নগুরিয়া গ্রামের বিশ্বজিৎ আদক, গোপাল কারক, প্রদীপ আদকেরা পৈতৃক সূত্রে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এঁদের বাবা-কাকারা ৪০ বছর আগেও গঙ্গাসাগরে হোগলা পাতার চাদর সরবরাহের কাজ করতেন। বিশ্বজিতেরা জানাচ্ছেন, প্রতি বান্ডিল হোগলা কিনতে খরচ হয় ৪০০ টাকা। এক বান্ডিল হোগলা থেকে সাতটি বড় এবং তিনটি ছোট চাদর তৈরি করা যায়। চাদর বানানোর জন্য কাঁচা হোগলাকে রোদে শুকনো করতে হয়। এরপর প্রয়োজন মতো আকারে সেগুলি কেটে ফেলা হয়। তারপর হাতের বিশেষ কাজের দ্বারা সুতলি সুতোর সাহায্যে এক একটি হোগলা ঘাসকে জুড়ে তৈরি করা হয় চাদর। সাড়ে ৮ ফুট বাই ৬ ফুট এবং সাড়ে ৭ ফুট বাই ৫ ফুট—এই দু’টি আকৃতির চাদর তৈরি করা হয়।
স্থানীয় সূত্রের খবর, অন্তত পঁয়ত্রিশ বছর আগে গঙ্গাসাগরে হোগলার চাদর সরবরাহের কাজ শুরু করেছিলেন নগুরিয়ার বাসিন্দা নিমাই আদক। তিনি পরে গ্রামে হোগলা চাদর তৈরির কাজ পরিচালনা করেন। কয়েক বছর হল নিমাইয়ের দুই ছেলে বিশ্বজিৎ আদক ও দীপক আদক হোগলার চাদর নিয়ে পাড়ি দেন গঙ্গাসাগরে। নৌকো পথে কোলাঘাট থেকে গঙ্গাসাগর যেতে ন’ঘণ্টা সময় লাগে। মেলায় ছাউনির জন্য প্রায় ৫০ হাজার হোগলার চাদর দরকার হয়। এর মধ্যে নিমাইরাই ২০ হাজার চাদর সরবরাহ করেন।
প্রদীপ বলেন, ‘‘বড় চাদরগুলি ১২৫ টাকা এবং ছোটগুলি ১১৫ টাকা দরে বিক্রি হয় মেলায়।এটাই আমাদের মূল পেশা। আগে বাবা ব্যবসা করত, এখন আমি আর দাদা হাল ধরেছি।’’ গ্রামের বাসিন্দা গৌতম বলেন, ‘‘১০০ থেকে ২০০ টাকা করে মজুরি জোটে। সারা বছর চাষের কাজের পাশাপাশি হোগলার চাদর তৈরি করে বাড়তি কিছু আয় হয়।’’ পিছিয়ে নেই মহিলারাও। চম্পা হাজরার কথায়, ‘‘সংসারের কাজ সামলে পাতা সেলাই করতে বসে পড়ি।’’
বর্তমানে কোলাঘাটের চাদরের চাহিদা বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন প্রদীপেরা। তাঁরা জানান, চাহিদা বাড়ায় রূপনারায়ণের চরের হোগলায় হচ্ছে না। তাই উলুবেড়িয়ায় এখন চাষ হচ্ছে হোগলার। গঙ্গাসাগর মেলা ছাড়া অন্য জায়গাতেও চাদর বিক্রি করেন নগুরিয়ার বাসিন্দারা। কিন্তু গঙ্গসাগর মেলা হল বিক্রিবাটার মূল জায়গা। তাই আগামী ক’টা দিন নাওয়াখাওয়ার সময় নেই বিশ্বজিৎ, প্রদীপদের।