পড়ে রয়েছে তার দিয়ে ঘেরা বেড়া। উধাও ম্যানগ্রোভের চারা। পদিমা-৩ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। নিজস্ব চিত্র
উপকূলের ক্ষয় রোধে এবং ইয়াস, আমপানের মতো ঝড়ের গতি রোধে ম্যানগ্রোভ অরণ্য তৈরির উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক উদ্যোগে বহু টাকা ব্যয়ে বছর বছর ম্যানগ্রোভের চারা রোপণ করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাস ঘোরার আগেই সেই সব চারা মারা যাচ্ছে। রামনগর ব্লক এলাকায় উপকূলে যে উদ্দেশ্যে ম্যানগ্রোভ রোপণ চলছে, তা উদ্দেশ্যপূরণ অধরাই থেকে যাচ্ছে।
রামনগর-১ ব্লকের পদিমা-২ পঞ্চায়েত এলাকার সমস্ত সমুদ্র বাঁধই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ওই ব্লক এলাকায় দিঘা মোহনার অদূরে মৈত্রাপুর, বেগুনাডিহা এবং আটিলি চরে এক বছর আগে সরকারি ভাবে কয়েক হাজার ম্যানগ্রোভ চারা লাগানো হয়েছিল। সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গিয়েছে, কিছু কিছু অংশে চারা গাছের কোনও অস্তিত্বই নেই। চারদিকে শুধু কাঁটা তার দিয়ে বেড়া করা রয়েছে। হাতে গোনা কিছু কাঁকড়া জাতীয় ম্যানগ্রোভ গাছ জোয়ারের সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঁকি মারছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলছেন, ‘‘এখানে চারা লাগানোর কয়েক দিনের মধ্যেই তা মরে যেতে শুরু করে। রক্ষণাবেক্ষণ তেমন কিছু করতে দেখিনি।’’ একই অবস্থা এই পঞ্চায়েতের দিঘার প্রবেশ পথের পাশ দিয়ে মেরিন ড্রাইভের যে রাস্তা ন্যায় কালী মন্দিরের দিকে চলে গিয়েছে, সেখানও। ওই রাস্তায় কংক্রিটের বাঁধের ধারে এক সময় লাগানো হয়েছিল কাঁকড়া, গেওয়া, সুন্দরী এবং গামা গাছ। এখন সে সব জায়গা ধু ধু প্রান্তর। ব্লকের পদিমা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অবশ্য প্রাকৃতিকভাবে কিছু কাঁকড়া জাতীয় ম্যানগ্রোভের গাছ বড় হয়ে গিয়েছে। সেগুলি ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গত বছর ২৮ জুলাই বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস সাড়ম্বরে পালিত হয়েছিল এই এলাকায়। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে লাগানো হয়েছিল ম্যানগ্রোভ চারা। বর্তমানে সেই চারা অবস্থা প্রসঙ্গে পদিমা-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মৃন্ময়ী প্রধান বলেন, ‘‘কিছু কিছু ম্যানগ্রোভ নষ্ট হয়েছে বিভিন্ন কারণে। রোপণ করার সময় কিছু কিছু মরা ম্যানগ্রোভ চারা লাগানো হয়েছিল। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। আমরা চেষ্টা করছি যাতে সব ম্যানগ্রোভ বাঁচানো যায়।’’ রামনগর -১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শম্পা মহাপাত্র বলেন, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে ম্যানগ্রোভ বাঁচানো যাচ্ছে না, তা ঠিক। রক্ষণাবেক্ষণ যাতে সঠিক ভাবে হয়, সে দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।’’
অন্যদিকে, কাঁথি দেশপ্রাণ ব্লকের ভোগপুর, বাকিপুট এলাকায় বছর দুয়েক আগে লাগানো হয়েছিল ম্যানগ্রোভ গাছ। নিয়মিত পরিচর্যার ফলে সেই সব গাছ এখন অনেকটাই বড় হয়েছে। বন দফতর সূত্রের খবর, ম্যানগ্রোভ চারা রোপণ কর্মসূচি সফল করতে ন্যূনতম পক্ষে তিন বছর সময় লাগে। যে সময় ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানো হয়, তার এক বছর অন্তর ম্যানগ্রোভের ক্ষয়ক্ষতি দেখার পর সেখানে পুনরায় রোপণ করতে হয়। পর্যায়ক্রমে পরের বছর একই সময় ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হয়। তা হলেই সমস্ত ম্যানগ্রোভের চারা বাঁচানো সম্ভব। ব্লক প্রশাসন সূত্রে খবর, এক একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বীজ লাগাতে সব মিলিয়ে খরচ ধরা হয় প্রায় ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয় বীজের জন্য। বাকি টাকা বীজ রোপণ, বেড়া দেওয়া-সহ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে খরচ হয়। অভিযোগ, এক্ষেত্রে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে বেশ কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা মেলেনি। তার ফলে মার খাচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল এলাকায় ম্যানগ্রোভ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার কাজ।
আপাতত জেলায় এক হাজার হেক্টর জমিতে ম্যানগ্রোভের চারা লাগানো হয়েছে। তার মধ্যে শুধু গত বছরই লাগানো হয়েছে ৫০০ হেক্টর জমিতে। বছর কয়েক আগে লাগানো হয়েছে বাকি জমিতে। যার অধিকাংশই কাঁথি মহকুমার উপকূলবর্তী এলাকায় রয়েছে। সামান্য কিছু ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছিল নন্দীগ্রাম এবং হলদিয়ায়। সে ক্ষেত্রেও বাকি ম্যানগ্রোভের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত উপকূলের বাসিন্দারা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বন আধিকারিক অনুপম খান অবশ্য বলছেন, ‘‘সরাসরি যেসব জায়গায় ম্যানগ্রোভ রোপণ বন দফতর করেছে, সেখানে রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবেই হচ্ছে। তবে, যেসব এলাকায় একশো দিনের কাজে প্রকল্পে ম্যানগ্রোভের চারা লাগানো হয়েছিল সেখানে সরকারি বরাদ্দ আটকে রয়েছে। পরিচর্যা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ম্যানগ্রোভের চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যাতে বিকল্পভাবে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আর্জি জানিয়েছি।’’