নেতৃত্বে ভাঙন ধরিয়ে দল ছাড়লেন লক্ষ্মণ-জায়া

সিপিএম লক্ষ্মণ শেঠকে বহিষ্কার করার পরে তিনি বলেছিলেন, দলের সিদ্ধান্তই তাঁর সিদ্ধান্ত। চার মাসের মধ্যে দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন লক্ষ্মণ-জায়া তমালিকা পণ্ডা শেঠ। শুধু তমালিকা নন, সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর মোট ৬ জন এবং জেলা কমিটির ১২ জন শনিবার দল ছেড়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন বিধায়ক অমিয় সাহু ও নন্দীগ্রামের নেতা অশোক গুড়িয়াও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তমলুক শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৪ ০১:৫৬
Share:

ডান দিকে অশোক গুড়িয়া এবং বাঁ দিকে অমিয় সাহুকে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক তমালিকা পণ্ডা শেঠের। তমলুকের নিমতৌড়িতে। —নিজস্ব চিত্র

সিপিএম লক্ষ্মণ শেঠকে বহিষ্কার করার পরে তিনি বলেছিলেন, দলের সিদ্ধান্তই তাঁর সিদ্ধান্ত। চার মাসের মধ্যে দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন লক্ষ্মণ-জায়া তমালিকা পণ্ডা শেঠ।

Advertisement

শুধু তমালিকা নন, সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর মোট ৬ জন এবং জেলা কমিটির ১২ জন শনিবার দল ছেড়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন বিধায়ক অমিয় সাহু ও নন্দীগ্রামের নেতা অশোক গুড়িয়াও। দল ছেড়েছেন জোনাল কমিটি স্তরের আট নেতাও। দলত্যাগীদের প্রায় সকলেই লক্ষ্মণ-অনুগামী বলে পরিচিত। এর ফলে জেলা সিপিএমে লক্ষ্মণ-রাজ কার্যত শেষ হয়ে গেল।

তমলুকের নিমতৌড়িতে এক অতিথিশালায় সাংবাদিক বৈঠকে দলত্যাগের কথা ঘোষণার সময় তমালিকা দাবি করেন, “আমরা দল ছাড়তে চাইনি। কিন্তু রাজ্য নেতৃত্ব আমাদের বাধ্য করেছেন। অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।” লক্ষ্মণের প্রতিক্রিয়া, “স্তাবকদের দিয়ে পার্টি চলছে। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে রাজ্য নেতারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কে অসৎ। এ ভাবে চললে পার্টি এক দিন রক্তমাংসহীন কঙ্কালে পরিণত হবে।”

Advertisement

তমালিকারা অবশ্য এ দিন কোনও নতুন দল গড়া বা অন্য দলে যোগ দেওয়ার কথা জানাননি। লক্ষ্মণও জানান, তাঁর বা তাঁর অনুগামীদের আপাতত অন্য কোনও দলে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। আগামী ১ অগস্ট কলকাতায় কনভেশন ডাকা হয়েছে। সে দিনই ‘ভারত নির্মাণ মঞ্চ’ গড়ে তাঁরা পরবর্তী রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করবেন। তবে পরে পরিস্থিতি বুঝে কোনও দলে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনাও তিনি উড়িয়ে দেননি।

কেন এই দলত্যাগ?


সবিস্তার দেখতে ক্লক করুন...

তমালিকার অভিযোগ, বিগত জেলা সম্মেলনের পরে জেলা সম্পাদকমণ্ডলী গঠনের দিন থেকেই সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব একের পর এক ‘স্বেচ্ছাচারী’ ও ‘অগণতান্ত্রিক’ পদক্ষেপ করে চলেছেন। আলিমুদ্দিনের তরফে পূর্ব মেদিনীপুরের দায়িত্বে রয়েছেন রবীন দেব। তমালিকার আক্ষেপ, “আগে সুকুমার সেনগুপ্ত, অনিল বিশ্বাসের মতো নেতারা জেলায় এসে পার্টিকর্মীদের অনুপ্রাণিত করতেন। কিন্তু এখন যাঁরা নেতৃত্বে আসছেন, তাঁরা শুধু তাঁবেদার তৈরি করছেন।” তিনি সরাসরি অভিযোগ করেন, “রবীন দেব আসার পর থেকেই জেলা পার্টির মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। পছন্দের লোকদের নিয়ে তিনি গোষ্ঠী তৈরি করেছেন।”

ঘটনাচক্রে, এ দিন নিমতৌড়িতে সিপিএমের জেলা কার্যালয়ে সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দুই রাজ্য নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ও রবীন দেব। সূর্যকান্তবাবু দলত্যাগ নিয়ে মুখ না খুললেও রবীনবাবু সাংবাদিকদের বলেন, “এক জন সদস্যের চলে যাওয়াও দলের পক্ষে ক্ষতিকর। তবে যাঁরা দলের মধ্যে থেকে দলের ক্ষতি করছিলেন, তাঁদের নিয়ে কিছু বলার নেই।” একই সঙ্গে তাঁর মত, জেলায় মোট ১৭ হাজার সিপিএম সদস্য রয়েছেন। এ দিন তাঁরা ৬১ জনের পদত্যাগপত্র পেয়েছেন। তাতে দলের নতুন করে ক্ষতি হবে না।

গত ২৭ মার্চ দলবিরোধী কাজের অভিযোগে তমলুকের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠকে বহিষ্কার করেছিল সিপিএম। সেই সময়ে দলের বিশ্বস্ত সৈনিকের সুরেই কথা বলেছিলেন হলদিয়ার কাউন্সিলর তমালিকা। ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে দলের দায়িত্ব বড় বলে জানিয়েছিলেন। নেত্রী হিসেবে তাঁর দক্ষতা নিয়ে দলের উপরমহলেও কোনও সংশয় ছিল না। ২০১১ সালে সিপিএমের রাজ্য জোড়া বিপর্যয়ের পরের বছরেও হলদিয়ায় পুরভোট জিতে প্রধান হয়েছিলেন তমালিকা। কিন্তু লক্ষ্মণ বহিষ্কৃত হওয়ার পরে তিনি কী ভাবে দলে কাজ চালাবেন, তা নিয়ে সংশয় ছিলই। লক্ষ্মণ নিজেও মনে করছিলেন, তমালিকা এ ভাবে বেশি দিন চালাতে পারবেন না।

লোকসভা নির্বাচনেও তমালিকা এবং লক্ষ্মণ-ঘনিষ্ঠ কিছু নেতাকে বেশ কিছু দায়িত্ব দিয়েছিল সিপিএম। কিন্তু নিমতৌড়িতে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তিন সদস্যকে নিগ্রহ ও ভোটের কাজে অসহযোগিতা লক্ষ্মণ শিবিরের বিরুদ্ধে এই দুই অভিযোগ ওঠার পর থেকেই পরিস্থিতি ঘোরালো হতে থাকে। যার পরিণতি এই দলত্যাগ। এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করা হয়েছে, পদত্যাগীদের দলে মোট ২১২৬ জন সিপিএম সদস্য আছেন। রয়েছেন প্রণব দাস, প্রশান্ত পাত্র ও শক্তিপদ বেরার মতো নেতারাও। কয়েক জনের বিরুদ্ধে অবশ্য আগেই ব্যবস্থা নিয়েছিল দল। জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় সাহু, প্রণব দাস ও প্রশান্ত পাত্রকে তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল। বহিষ্কৃত হয়েছিলেন জেলা কমিটির অমিত দাস ও বিজন রায়।

সিপিএমের জেলা সম্মেলনের আর কয়েক মাস বাকি। তার আগে গোটা লক্ষ্মণ বাহিনী দল ছাড়ায় জেলায় সিপিএমের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠে গেল।

যে ঘটনার সূত্রে জেলা তথা দলে লক্ষ্মণ শেঠের ক্ষমতা হারানো শুরু, সেই নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে দলের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ উগরে দিয়ে তমালিকা বলেন, “নন্দীগ্রাম পর্বে বহু সিপিএম কর্মী-সমর্থকের প্রাণ গিয়েছে। তার পরেও পার্টি বলেছে নন্দীগ্রাম ক্লোজড চ্যাপ্টার। এর থেকে দুর্ভাগ্যের কী হতে পারে!” আগামী দিনে নন্দীগ্রাম-খেজুরিতে আক্রান্ত এবং মামলা-জর্জরিত মানুষের পাশে থাকারও আশ্বাস দেন তিনি। তমালিকার কথায়, “আমরা রাজনীতি ছেড়ে যাব না। নন্দীগ্রাম-খেজুরির মানুষের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement