বেলদা স্টেশনের কাছে ক্ষুদিরামের মূর্তি। নিজস্ব চিত্র
পোশাকের দিকে নজর ছিল পুলিশের। ব্রিটিশ পুলিশের। স্টেশনে ওঁৎ পেতে থাকত তারা। যদি দেখা যেত কোনও যাত্রীর পোশাকের সঙ্গে সত্যাগ্রহীদের মিল রয়েছে তাহলেই বিপদ। কন্টাই রোড স্টেশন একসময়ে হয়ে উঠেছিল যাত্রীদের ত্রাস। কেন? জানার আগে একটু প্রেক্ষাপট জেনে নেওয়া যেতে পারে।
মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর নেতৃত্বে লবণ সত্যাগ্রহ ১৯৩০ সালে আরম্ভ হয়। এই আন্দোলনে মেদিনীপুর জেলা ছিল সামনের সারিতে। জেলাটি সমুদ্রকূলবর্তী হওয়ায় বেআইনি লবণ তৈরির বিস্তর সুযোগ ছিল। আবার কাঁথি মহকুমা ছিল লবণ সত্যাগ্রহের অন্যতম কেন্দ্র। ৭ মার্চ কুমিল্লা অভয় আশ্রমের সভাপতি সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যতম সদস্য অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরী ও নৃপেন্দ্রনাথ বসু গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র তীরে লবণ প্রস্তুতের কথা আলোচনা করেন। গাঁধী তাঁদের মেদিনীপুর জেলায় কাজ করার সম্মতি জানান। সেই সময়ে কাঁথি যাওয়ার অন্যতম পথ ছিল মেদিনীপুর সদর মহকুমার কন্টাই রোড স্টেশন। স্টেশনে নেমে বাসে পূর্বদিকে সড়ক পথে যেতে হত। সম্ভবত সেই কারণে স্টেশনের নাম ‘কন্টাই রোড’।
১৯৩০ সালের ৫ এপ্রিল সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ২৮ জন সত্যাগ্রহী-সহ কুমিল্লা থেকে বাঁকুড়া আসেন। সেখান থেকে মেদিনীপুর হয়ে ট্রেনে কন্টাই রোড স্টেশনে পৌঁছন। স্টেশন থেকে একটি জাতীয় পতাকায় সাজানো বাসে করে তাঁদের কাঁথি আনা হয়েছিল। তার আগে স্টেশনে তাঁদের মালা-চন্দন দিয়ে বরণ করে বিপুল উৎসাহে অভ্যর্থনা জানানো হয়। এই সময় বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে সত্যাগ্রহীদের কাঁথিতে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ার উৎসাহ দেখা দিয়েছিল। তাই সরকার বাইরের লোকদের আটকাতে কাঁথি ঢোকার প্রধান পথগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা করে। কন্টাই রোড স্টেশনে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসে। নিয়ম করা হল, স্টেশনে নামা যাত্রীরা পরিচয় দিয়ে তবেই বেরতে পারবেন। কেউ যদি খদ্দরের পোশাক পরে ট্রেন থেকে নামতেন তাহলে বেশ বিপাকে পড়তে হত। তাঁদের পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হত। স্বেচ্ছাসেবক সন্দেহে অনেককে জোর করে ফিরতি ট্রেনে তুলে দেওয়া হত। এমন অবমাননাকর ব্যবস্থা বন্ধ করতে চেয়ে কেউ কেউ অনশন করতেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হত না। ব্যবস্থা কড়াকড়ি হওয়া লবণ সত্যাগ্রহী স্বেচ্ছাসেবকেরা কন্টাই রোড স্টেশন এড়াতে শুরু করলেন। তাঁরা কন্টাই রোড স্টেশনের আগে নারায়ণগড়, বাখরাবাদ বা পরের স্টেশন নেকুড়সেনি বা দাঁতনে নামতেন। তার পর হেঁটে কাঁথি লবণকেন্দ্রে পৌঁছতেন।
অবিভক্ত বাংলার জননেতা তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মন্ত্রী নিশীথনাথ কুণ্ডু কন্টাই রোড স্টেশনে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। তাঁর লেখা অনুযায়ী, ‘কন্টাই রোড স্টেশনে বেত হাতে সাদা পোশাকে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। খদ্দর পরা মানুষকে ধরে পুলিশ দেখে, তার গায়ে কখানা খদ্দর আছে। যদি দেখে একখানা চাদর তবে দু’বেত মারে। যদি দেখে টুপি ও চাদর খদ্দরের তাহলে চার বেত মারে। আর টুপি, চাদর ও কাপড় তিনখানই খদ্দরের তাহলে ছয় বেত মারে। এখানকার পুরুষরা দিনে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন, কেবল মেয়েরা গ্রামে থাকেন। পুলিশ দেখা মাত্র তাঁরা শাঁখ বাজান, একজন শাঁখ বাজালে তার শব্দ শুনে আরেকজন বাজান এবং সমস্ত গ্রামে চারদিক থেকে শাঁখ বেজে উঠে। এরকম শাঁখের ধ্বনি হলেই গ্রামের মেয়েরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুলিশের সম্মুখীন হন। এরূপ ঐক্যবদ্ধ মেয়েদের দেখে পুলিশ আর তাঁদের উপর অত্যাচার চালাতে পারে না, ফিরে যায়’।
নিশীথনাথ কুণ্ডু আইনজীবী ছিলেন। কাঁথি জেলে আটক যতীন্দ্রমোহন রায় ও প্রফুল্লচন্দ্র সেনের জামিনের ব্যবস্থা করতে কন্টাই রোড স্টেশনে নামেন। নামামাত্র সাদা পোশাকের পুলিশ তাঁর হাত ধরে ফেলে। নিশীথনাথ ধমক দেওয়ায় কনস্টেবল হাত ছেড়ে দিয়ে থানায় যেতে বলেন। অস্থায়ী থানায় আইনজীবী সরাসরি দারোগাকে বলেন ‘শুনেছিলাম কন্টাই রোড স্টেশনে বেত হাতে পুলিশ থাকে। খদ্দর পরা যাত্রী নামলেই তাঁকে ধরে বেত মারা হয়। আমি দেখেছি পুলিশের এরূপ অপমানকর ব্যবহারের সংবাদ সত্যই’। থানায় পুলিশ অফিসার একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। নিশীথনাথের মনে হল, অফিসার ভুল বুঝতে পেরেছেন। আইনজীবী তখন বলেন, ‘আমি পাবলিক বাস ধরতে পারলাম না। অনর্থক মহকুমা শাসক ও পুলিশ সুপার সামসুদ্দোহার সঙ্গে দেখা করার কাজে ব্যাঘাত হল। তখন দারোগা বললেন আমরা বাসের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, আমি তাদের ঐ সাহায্য প্রত্যাখান করে অন্য বাসে কাঁথি আসি’।
নিশিথনাথ কুণ্ডু কাঁথি এসে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের ভাইয়ের বাড়িতে উঠলেন। পরে মহকুমা শাসক গফুর সাহেবের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইলেন। গফুর সাহেব কাঁথির পুলিশ সুপার সামসুদ্দোহাকে ডেকে পাঠান। তিনি আসতেই নিশীথনাথ তাঁকে বলেন ‘আপনার চেহারাটি বড় সুন্দর। সংস্কৃতে একটি শ্লোক আছে যে সুন্দর দেহে একটি সুন্দর আত্মা থাকা দরকার। তবে আপনি সত্যাগ্রহীদের উপর নির্মম অত্যাচার করেন কি করে’? তার পর তিনি যতীন্দ্রনাথ রায় ও প্রফুল্ল সেনের জামিনের কথা বলেন। সামসুদ্দোহা দু’জনকে কাঁথি ছেড়ে চলে যাওয়া শর্তে জামিন দিতে রাজি হলেন। পরদিন কন্টাই রোড স্টেশনে সামসুদ্দোহার সঙ্গে নিশীথনাথ কুণ্ডুর দেখা। তিনি আটক ছেলেদের কাঁথি জেল থেকে নিয়ে কন্টাই রোড স্টেশনে গাড়িতে তুলে দিতে এসেছিলেন। কন্টাই রোড স্টেশনে পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে সেখানকার গ্রামবাসীদের অনেক কৌশল নিতে হয়েছিল। যে সত্যাগ্রহীরা আসতেন তাঁদের যত্ন নেওয়ার জন্য স্টেশনে লোক থাকত। তাঁদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা গ্রামবাসীরা করতেন। কোন বাড়িতে কতজন কোন সময়ে খাবেন তা ঠিক করা ছিল। গ্রামবাসীরা তাঁদের জন্য ঘরের দুয়ারে খাবার রেখে দিতেন।
১৯৪৩ সালে স্টেশন আবার শিরোনামে। জেলায় তখন দুর্ভিক্ষ। স্টেশনে মালবাহকেরা যখন সরকারের গুদামে ধান ও চালের বস্তা পাহারা দিচ্ছিলেন তখন ক্ষুধার্ত জনতা হামলা চালায়। মালবাহকদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সরকারি গুদামের অধিকর্তা ও স্টেশন মাস্টারও রেহাই পাননি। গুদাম থেকে জনতা বেশ কিছু ধানের বস্তা কেড়ে নেয়। অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য কাঁথি থেকে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠানো হয়। কিন্তু ক্ষিপ্ত জনতা ম্যাজিস্ট্রেটকে আক্রমণ করে। গুদামের অধিকর্তাকে আবার মারধর করে। মারমুখী হওয়ার কারণ ছিল। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে এই স্টেশন দিয়ে ৩৪ হাজার ২৭৭ মণ ১০ সের ধান ও ১৮ হাজার ১৮৭ মণ ২৯ সের চাল রফতানি করে। দাঁতন, বাখরাবাদ, নারায়ণগড়, বেনাপুর, খড়গপুর, জকপুর, মাদপুর, শ্যামচক, বালিচক, হাউর, পাঁশকুড়া, ভোগপুর ও মেচেদা থেকেও শস্য রফতানি হয়। এক মাসের মধ্যে ৫ লক্ষ মণের বেশি ধান রফতানি হয়। এতে ধানের দাম বাড়ে।
কন্টাই রোড এখন নেই। বেলদাবাসীর আন্দোলনের ফলে ২০১০ সালে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে বেলদা রাখা হয়েছে। এলাকাটি এখন খড়্গপুর মহকুমার অন্তর্গত। কিন্তু এই স্টেশনে নেই কোনও ফলক। যা থেকে হঠাৎ আগত যাত্রী বা নবীন প্রজন্ম স্বাধীনতা আন্দোলনে স্টেশনটির ভূমিকার কথা জানতে পারেন। তবে স্টেশনের সামনে কয়েক বছর আগে কয়েকজনের প্রচেষ্টায় শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।
লেখক প্রাবন্ধিক