ত্রাণের চালে ক’দিন চলবে, প্রশ্ন অর্চনাদের

জলের তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছে বাড়ি। কোমল জল ঠেলে অনেকটা পথ পেরিয়ে কেশপুরের পঞ্চমীতে ত্রাণ শিবিরে এসেছিলেন লক্ষ্মী কোটাল, সীমারানি দাস, জবা বাতুল, গীতা ধারা, অর্চনা দোলুই, সৌরানি দোলুইরা।

Advertisement

বরুণ দে ও দেবমাল্য বাগচি

কেশপুর ও পিংলা শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৫ ০০:৫০
Share:

জলের তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছে বাড়ি। কোমল জল ঠেলে অনেকটা পথ পেরিয়ে কেশপুরের পঞ্চমীতে ত্রাণ শিবিরে এসেছিলেন লক্ষ্মী কোটাল, সীমারানি দাস, জবা বাতুল, গীতা ধারা, অর্চনা দোলুই, সৌরানি দোলুইরা। কেউ এসেছেন নৌকোয় চেপে, কেউ প্রশাসনিক উদ্যোগে। অবশ্য অপর্যাপ্ত ত্রাণ পেয়ে আক্ষেপ গোপন করলেন না কেউ। সোমবার সকালে কেশপুরে যান রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ত্রাণ শিবিরে আসা বন্যার্তদের কেউ কেউ ত্রাণ নিয়ে অসন্তোষের কথা মন্ত্রীকেও জানান।

Advertisement

পঞ্চমীতে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে দু’টি ত্রাণ শিবির হয়েছিল। একটি সরকারি উদ্যোগে। অন্যটি শাসক দলের উদ্যোগে। কেশপুরের বন্যা পরিস্থিতি দেখতে এসে দু’টি শিবিরেই যান পঞ্চায়েতমন্ত্রী। ছিলেন জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা, জেলা পুলিশসুপার ভারতী ঘোষ প্রমুখ। সরকারি শিবির থেকে কয়েকজনকে ত্রাণ সামগ্রীর প্যাকেট দেওয়া হয়। শাসক দলের শিবির থেকেও বেশ কয়েকজনকে প্যাকেট দেওয়া হয়। যেখানে ছিল দু’কিলোগ্রাম চাল, দু’কিলোগ্রাম আলু, এক প্যাকেট চিঁড়ে আর এক প্যাকেট বিস্কুট। যদিও এই সামান্য ত্রাণ দিয়ে কী হবে, প্রশ্ন বন্যার্তদের একাংশের।

অর্চনাদেবীর চারজনের সংসার। দুই ছেলেমেয়েই নাবালক। এই গৃহবধূ বলছিলেন, “তিন দিন ধরে যে কী অবস্থায় আছি বলে বোঝাতে পারব না। ঘর জলের তলায়। চারজনের সংসারে এই চাল- আলু আর কতদিন চলবে?” “এক কোমর জল ঠেলে এখানে এসেছি। জল না নামলে আরও দুর্ভোগ সইতে হবে। পোড়া কপাল আমাদের!” বলে চলেন সৌরানিদেবী।

Advertisement

লক্ষ্মী কোটাল, সীতারানি দাসরা সরকারি শিবির থেকে ত্রাণ পেয়েছেন। লক্ষ্মীদেবী বলছিলেন, “অনেকটা পথ। জল ঠেলে আসা সম্ভব হত না। পুরো এলাকাই জলের তোলায়। প্রশাসন নৌকোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেই নৌকোয় চেপেই কয়েকজন ত্রাণ নিতে এসেছি।” কাপাসটিকরির নিতাই দোলুইয়েরও বক্তব্য, “পারাং নদীর বাঁধ ভেঙেই সব শেষ হয়ে গেল!”

দুর্গতদের হাহাকার দেখতে পেয়েছেন মন্ত্রীও। শুনেছেন তাঁদের অসন্তোষের কথা। মন্ত্রীর কাছে কেউ কেউ আর্জি জানান, ‘চাল- ত্রিপল পাইনি, একটু দেখবেন।’ কারও আর্জি, ‘পানীয় জলের পাউচ পাচ্ছি না।” বন্যা পরিস্থিতি দেখতে এসে দুর্গতদের এই হাহাকার এড়িয়ে যেতে পারেননি পঞ্চায়েতমন্ত্রীও। সম্ভবত তাই তিনি সরকারি শিবিরে বক্তব্য না- রাখলেও দলীয় শিবিরে এসে ত্রাণ বিলির পরে বক্তব্য রাখেন। জানিয়ে দেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য সরকার তত্‌পর রয়েছে। ত্রাণের কাজে প্রশাসন সব রকম চেষ্টা করছে।

সুব্রতবাবু বলেন, “বন্যা কবলিত মানুষ যে ভাবে বাঁচার জন্য লড়াই করছেন এবং আমাদের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসছেন, তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ। সরকার থেকে যথেষ্ট ত্রাণও দেওয়া হচ্ছে।’’ তিনি আরও দাবি করেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন, আরও দরকার হলে সরকারই তার ব্যবস্থা করবে।”

মন্ত্রীর কথায়, “প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। আরও বেশি ত্রাণের ব্যবস্থা করার জন্য চেষ্টা চলছে। সীমিতা ক্ষমতা নিয়ে কেশপুর ব্লক তৃণমূল পাশে দাঁড়িয়েছে। চাল- আলু নিয়ে হাজির হয়েছে। হয়তো এটা যথেষ্ট নয়। কিন্তু, তাদের এই সত্‌ উদ্যোগটাকে নিশ্চয়ই আপনারা আশীর্বাদ করবেন।’’ সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘আমরা চাই, তাড়াতাড়ি জল নেমে যাক। মানুষ নিজের নিজের বাসস্থানে ফিরে যাক। ফিরে যাওয়ার পরে যে সব ত্রাণের প্রয়োজন হবে, আমাদের প্রশাসন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তার ব্যবস্থা করবে। যতদিন পর্যন্ত প্রয়োজন, ততদিন পর্যন্ত পাশে থাকবে।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়ও বলেন, “প্রশাসন সাধ্য মতো দুর্গতদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। দলীয় উদ্যোগেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিলির কাজ চলছে। সীমিত ক্ষমতার মধ্যে যা করা সম্ভব, তাই করা হচ্ছে।”

সোমবার কেশপুরের ত্রাণ বিলির শিবিরে এসেছিলেন জেলার সভাধিপতি উত্তরা সিংহ, মেদিনীপুরের (সদর) মহকুমাশাসক অমিতাভ দত্ত, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) অংশুমান সাহা প্রমুখও। জলাধারের ছাড়া জল এবং ভারী বৃষ্টি- এই দুইয়ে বানভাসি হয়েছে জেলার একাংশ। বিপন্ন বহু মানুষ। এখন জেলার যে সব এলাকার পরিস্থিতি বেশ খারাপ, তারমধ্যে কেশপুর অন্যতম। এখানে সবমিলিয়ে ১৭টি ত্রাণ শিবির খুলতে হয়েছে। বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। একের পর এক গ্রামে হু হু করে জল ঢুকেছে। জেলার এই এলাকায় সবমিলিয়ে ৩৬টি জায়গায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেমন এনায়েতপুরের ৫টি, বিবেকপুরের ১টি, কলাগ্রামের ৪টি, সরিষাকোলার ৬টি, ঝেঁতল্যার ৩টি, মুগবসানের ৫টি। আরও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা মন্ত্রীরও। তাঁর কথায়, “বাঁধ ভেঙে কিছু এলাকায় ব্যাপক জল ঢুকেছে। যদি আরও বেশি বাঁধ ভাঙে, তাহলে সমস্যা হবে। কয়েকটি গ্রাম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এই সব গ্রামে নৌকায় করে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।”

দাসপুরের কাছে শিলাবতী নদীর জলস্তর এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। পাঁশকুড়ার রানিচকের কাছে রূপনারায়ণও বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। অন্যদিকে, ডিভিসি থেকে জল ছাড়ার পরিমান বেড়েছে। ফলে, এখনই কেশপুরের পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। মেদিনীপুরের (সদর) মহকুমাশাসক অমিতাভবাবু বলেন, “ভারী বৃষ্টি না- হলেই ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।” একই বক্তব্য কেশপুরের বিডিও মহম্মদ জামিল আখতারের। তাঁর কথায়, “কেশপুরে বেশ কিছু ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিলির কাজ চলছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।” জবা বাতুল, গীতা ধাড়াদের অবশ্য দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না। জবাদেবীর কথায়, “তাড়াতাড়ি জল না- নামলে সব শেষ হয়ে যাবে! বাড়ি- জমি সব!” কেশপুরের আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা। পারাং নদীও ফুঁসছে।

কেশপুর থেকে পিংলার গোবর্ধনপুর ও বিষ্ণুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের জলমগ্ন এলাকাও পরিদর্শন করেন সুব্রতবাবু। পিংলাতেও মন্ত্রী বলেন, ‘‘সরকারিভাবে আমরা পর্যাপ্ত ত্রাণ দিচ্ছি। বৃষ্টির পরিমাণও কমে গিয়েছে। তবে যতদিন জল থাকবে ততদিন ত্রাণ দেওয়া হবে।”

গত শুক্রবার থেকে দফায় দফায় বৃষ্টিতে সবং ও পিংলার নানা এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কেলেঘাই ও কপালেশ্বরী নদীর সংস্কার হওয়ায় বন্যা প্রবণতা অনেকাংশে কমেছে। তবে এ বারও সবংয়ের বিষ্ণুপুর, বুড়াল, মোহাড়, বলপাই, নারায়ণবাড়-সহ প্রায় দশটি পঞ্চায়েত এলাকায় বৃষ্টির জল খালপথে বেরোতে না পারায় জলবন্দি হয়ে রয়েছেন বহু মানুষ। অনেক মাটির বাড়িরও ক্ষতি হয়েছে। চণ্ডীয়া নদী জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় সমস্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্লাবিত হয়েছে গোবর্ধনপুর ও পিণ্ডরুই গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকা।

এ দিন মন্ত্রী প্রথমে যান পিংলার গোবর্ধনপুর অঞ্চলের রাজনা বটতলা এলাকায়। সেখানে সরকার ও দলের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে ২০০টি করে ত্রাণের কিট বিলি করা হয়। সরকারি শিবিরে মন্ত্রী সুব্রতবাবু বলেন, “আমি অতীতে কোনও সরকারকে দেখিনি যারা এ ধরনের কিট তৈরি করে ত্রাণ বিলি করছে। আগে বন্যা হলে খিচুরি খাওয়ানো হত। ফলে অনেকক্ষেত্রে আন্ত্রিকের প্রকোপ দেখা দিত। তবে আমরা শুধু খিচুড়ি খাওয়ানোতেই ত্রাণ সীমাবদ্ধ রাখছি না।”

পিংলা থেকে সুব্রতবাবু চলে যান সবংয়ে। মোহাড়ে একটি ত্রাণ শিবিরে যান তিনি। বিষ্ণুপুরের লাঙলকাটায় বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন সুব্রতবাবু। লাঙলকাটার আগে নোনামাধবচকে সরকারিভাবে ত্রাণ বিলি করেন মন্ত্রী। সেখানেই মন্ত্রী বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই বিপর্যয়ের খবর নিশ্চয় রয়েছে। তবে যে পরিমাণ সাহায্য করা প্রয়োজন কেন্দ্র তা করছে না। এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে।’’ যদিও অপর্যাপ্ত ত্রাণের অভিযোগে সরব বিরোধীরা। এ দিন বিকাশ ভুঁইয়া বলেন, “বন্যা দুর্গত এলাকার ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়। ত্রাণ বণ্টনেও দলবাজি হচ্ছে। সরকারের উচিত এলাকাগুলিকে অবিলম্বে বন্যা কবলিত বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করা।”

ত্রাণ না পাওয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে একাংশ এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে। বিষ্ণুপুর উত্তর বাঁধের খগেন্দ্রনাথ বর্মন বলেন, “আমার বাড়ি পর্যন্ত জল ঢুকে গিয়েছে। ৪২ ডেসিমেল জমিতে করা ধান চাষ একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। একটা ত্রিপল এখনও পেলাম না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement