পাঁশকুড়া ফুল বাজার চত্বরের বন্ধ হিমঘর। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।
হিমঘরের অভাব। সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না পদ্ম ফুল। হু হু করে বাড়ছে দাম। দুর্গোৎসবের মরসুমে সে দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পূর্ব মেদিনীপুরের ফুল চাষিরা। তাঁদের দাবি, যে ফুল গত বছর আড়াই-তিন টাকায় বিক্রি হয়েছিল, সেই ফুলই এ বছর বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি আট টাকা দরে। এই দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সারা রাজ্যে পদ্ম ফুলের একটা বড় অংশ আসে পূর্ব মেদিনীপুর থেকেই। পাঁশকুড়া ও কোলাঘাট এলাকায় রেললাইনের দু’পাশের ঝিল, মেদিনীপুর খালের পাশের জলাশয়গুলি আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ভরে যায় পদ্মে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় করেই কোলাঘাট স্টেশনের পাশের ফুল বাজার, পাঁশকুড়া ফুল বাজার থেকে সে সব ফুল ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যে। প্রতিদিন ভোরে ভোগপুর স্টেশনে শুধু পদ্মফুলের বাজার বসে। দুর্গাপুজোয় বেশি দাম পাওয়ার আশায় পাঁশকুড়া, কোলাঘাটের ব্যবসায়ীরা এই সময় থেকেই হিমঘরে ফুল জমিয়ে রাখতে শুরু করেন। সমস্যা সেখানই।
গত দু’বছর ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে শকুড়ার সরকারি ফুল বাজারের হিমঘর। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এর ফলে ক্রমাগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা। সম্প্রতি ওই হিমঘর খোলার দাবিতে রাজ্যের উদ্যান পালন মন্ত্রীর কাছে শুক্রবার স্মারকলিপি দিয়েছেন ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘সারা বাংলা ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতি’। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের উপ-অধিকর্তা সুফল মণ্ডল বলেন, ‘‘উদ্যান পালন দফতর হিমঘরের অবস্থা পরিদর্শন করেছে। ওই হিমঘর চালুর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।’’
উদ্যানপালন দফতর ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পাঁশকুড়া ও কোলাঘাট এলাকার ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য মেচগ্রাম এলাকায় ৬ নম্বর জাতীয় সরকারি ফুলবাজার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০০১ সালে প্রায় এক কোটি টাকা বরাদ্দ করে ওই ফুল বাজারের শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন উদ্যান পালন দফতরের মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। ২০০৪ সালে ওই বাজারের উদ্বোধন করেন তৎকালীন উদ্যান পালন দফতরের মন্ত্রী শৈলেন সরকার। বাজার চত্বরেই পাঁচ টন ফুল সংরক্ষণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি হিমঘর গড়ে তোলা হয়েছিল। তারপরে বন্ধ হয়ে যায় হিমঘর।
২০১২ সালে ওই ফুলবাজার পরিচালনার জন্য নতুন কমিটি গড়া হয়। চেয়ারম্যান হন পাঁশকুড়ার পুরপ্রধান জাকিউর রহমান খান। এরপর বন্ধ হয়ে থাকা ওই হিমঘর ফের চালু করা হয়। কিন্তু মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ফের অকেজো হয়ে গিয়েছে সেটি। জাকিউর রহমান খান বলেন, ‘‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই হিমঘর বন্ধ। ভিন রাজ্যের একটি প্রযুক্তি সংস্থার সাহায্য নিয়ে ওই যন্ত্র মেরামতি করতে হবে। এ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’’
সারা বাংলা ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির রাজ্য সম্পাদক নারায়ণ নায়েকের অভিযোগ, ‘‘সরকারি ফুল বাজারে নিয়মিত ফুল বেচাকেনা চলে। কিন্তু হিমঘর বন্ধ। এখনই দুর্গাপুজোর ফুল জমা করতে না-পারলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা।’’ এ বছর কম বৃষ্টিতে এমনতিই ফলন কম। কোলাঘাটের এক ফুল চাষি জানালেন, ভাল পদ্মের ফলনের জন্য অন্তত পাঁচ ফুট গভীরতার প্রয়োজন হয় জলাশয়ে। কিন্তু এ বার শ্রাবণ মাস পর্যন্ত তেমন জোরালো বৃষ্টি হয়নি। তাই সব জলাশয়ের গভীরতাই সাড়ে তিন থেকে চার ফুট। ফলে ফলন কমছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী সত্যব্রত মাইতি বলেন, ‘‘হিমঘর প্রায় দু’বছর বন্ধ। বেসরকারি হিমঘরে ফুল রাখতে হচ্ছে। এতে আমাদের খরচ বেশি হচ্ছে। পুজোর সময় ফুল রাখতে সমস্যা হচ্ছে।’’
পাঁশকুড়ার সরকারি হিমঘর বন্ধ থাকায় চাষিদের শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে মেচেগ্রামের একটি বেসরকারি হিমঘর। এটি মূলত আলুর হিমঘর। কিছুটা ফুল রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তাতে খরচ যথেষ্ট বেশি। চাষিরা জানাচ্ছেন, সরকারি হিমঘরে ছোট এক ঝুড়ি (এক হাজারটি ফুল) পদ্মফুল রাখতে ভাড়া দিতে হত ৫০ টাকা। বড় ঝুড়ি (২ হাজার ফুল) পিছু নেওয়া হত ১০০ টাকা। সেখানে বেসরকারি হিমঘরে প্রতি ছোট ঝুড়ি পদ্ম জমিয়ে রাখতে নেওয়া হয় ১০০ টাকা আর বড় ঝুড়ি পিছু ১৫০ টাকা। সরকারি হিমঘরে অন্তত ৫০ জন ফুল ব্যবসায়ী পদ্ম ফুল রাখতেন বলে জানান পদ্ম ব্যবসায়ীরা। পদ্ম ছাড়াও দুর্গাপুজোর আগে গাঁদা, গ্ল্যাডিওলাস প্রভৃতি ফুলও হিমঘরে জমিয়ে রাখা হত।