শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে চলছে গভীর নলকূপ তৈরির কাজ। —নিজস্ব চিত্র।
ভোট এসেছে। তাই ভোটারদের মন পেতে উন্নয়নমুখী কাজের বহর খড়গপুরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে।
কোথাও বেহাল রাস্তার সংস্কার, কোথাও ডিপ-টিউবওয়েল তৈরির কাজ চলছে জোরকদমে। অভিযোগ, গত পাঁচ বছরে উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও পৌঁছয়নি, এমন এলাকাতেও এখন কাজের বহর। বিরোধীদের অভিযোগ, গত ফেব্রয়ারি মাসে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, এমন প্রকল্পের কাজও চলছে এখন। ভোটারদের প্রভাবিত করতেই এই কাজের হিড়িক। যদিও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, মানুষ সবই দেখছেন। গত পাঁচ বছরে পাওয়া, না-পাওয়া নিয়ে সকলেরই স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। তাই শেষ মুহূর্তে বাজিমাত করার চেষ্টা বৃথা। উন্নয়নের নিরিখেই সকলে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
খড়্গপুরে জলের অভাবের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। শহরের সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। বেহাল রাস্তাও। এ জন্য বাড়ি বাড়ি প্রচারে গিয়ে বহু বিদায়ী কাউন্সিলরকেই ক্ষোভের মুখে পড়তে হচ্ছে। শহরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভোটের বাদ্যি বাজতেই কাজের গতি বেড়েছে। এ জন্য বিদায়ী কংগ্রেস পরিচালিত পুরবোর্ডকে বিঁধছেন বিরোধীরা। শহর তৃণমূল সভাপতি দেবাশিস চৌধুরী বলেন, “খড়্গপুর পুরসভায় ভোটের মুখে কাজের একটা ট্র্যাডিশন রয়েছে। তাই ভোটের আগেই টাকা বরাদ্দ হয়েছে। আর ৩৫টি ওয়ার্ডেই কমবেশি কাজ চলছে। এসব ভোটারদের প্রভাবিত করা ছাড়া কী হতে পারে! তবে এখন সরকারি অর্থে উন্নয়নমূলক কাজের থেকেও বিভিন্ন ওয়ার্ডে ব্যক্তিগত অর্থে বেশি কাজ দেখা যাচ্ছে।”
দেবাশিসবাবুর অভিযোগ, শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিআই প্রার্থীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন ক্লাব ঘর নির্মাণ ও পুজো উপলক্ষে অর্থ সাহায্য করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন বিদায়ী সিপিআই কাউন্সিলর লিপিকা বাগদীর ভাইঝি শর্মিষ্ঠা সিংহ। এই অভিযোগ প্রসঙ্গে শর্মিষ্ঠাদেবীর বাবা নিলু সিংহ বলেন, ‘‘শুধু ভোটের সময় নয়, সারা বছর আমি এলাকায় পুজোয় ভোগের চাল দান বা মানুষের পাশে থেকে সাহায্যের চেষ্টা করি।’’
শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে এ বার তৃণমূল প্রার্থী হয়েছেন দেবাশিস চৌধুরী। ওই ওয়ার্ডের বিধানপল্লি ও ছত্তীসপাড়া এলাকায় ডিপ-টিউবওয়েল খননের কাজ চলছে। এক সপ্তাহ আগে ছত্তীসপাড়া এলাকায় নর্দমা তৈরি ও একটি ঢালাই রাস্তা নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের দাবি, বিগত পাঁচ বছরে ওয়ার্ডে জল সঙ্কট নিয়ে উদাসীন ছিল পুরসভা। অথচ ভোটের আগে তড়িঘড়ি টিউবওয়েল তৈরির কাজ চলছে। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর রিনা শেঠ বলেন, ‘‘পুরসভায় তৃণমূল বোর্ড থাকাকালীন ওয়ার্ডের জন্য ১২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছিল। সেই টাকা আজও না পাওয়ায় কিছু কাজ করা যায়নি। তাই ভোটের আগে বরাদ্দ টাকা উন্নয়নের কাজে ব্যয় করে ফেলছি।’’ এ বিষয়ে ওই ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী বি মুরলিধর রাও বলেন, “উন্নয়নমুখী কাজ ভাল। তবে এতদিনে এলাকার কোনও উন্নয়ন না করে এখন কাজ করার কারণ মানুষ সব বুঝতে পারছে।’’
একইভাবে, দিন সাতেক আগেই শহরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে নতুন মোরাম রাস্তা নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়াও ভোটের মুখেই দীনেশনগরে দু’টি রাস্তা ও উত্তর তালবাগিচায় একটি ডিপ-টিউবওয়েল তৈরি হয়েছে। এই ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর তৃণমূলের জয়া পাল খড়্গপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান জহরলাল পালের বউমা। কয়েকদিন আগেও এলাকায় কাজের তদারকি করতে দেখা গিয়েছে জহরবাবুর ছেলে তৃণমূলের ওয়ার্ড কমিটির সম্পাদক অসিত পালকে। ভোটের আগে কাজ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বিদায়ী পুরবোর্ডের দিকেই দায় ঠেলে অসিত পাল বলেন, “ভোটের আগে পুরসভা টাকা বরাদ্দ করলে কাজ না করে কী টাকা ফেলে দেবে কাউন্সিলর? তাই প্রয়োজন অনুযায়ী টেন্ডার করে কাউন্সিলর কাজ করেছেন।’’
শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিদ্যাসাগরপুরে জলের সমস্যা দীর্ঘদিনের। দিন পনেরো আগে এলাকায় ডিপ-টিউবওয়েল তৈরি করা হয়েছে। ভোটের আগে কাজের বহরের তালিকা থেকে বাদ পড়েনি খড়্গপুরের বিদায়ী পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পাণ্ডের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডও। দীর্ঘদিন ধরে খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে ওই ওয়ার্ডের ওড়িয়া বস্তির পথবাতি। দিন চারেক আগে ওই এলাকায় ভেপার ল্যাম্পের বদলে একটি সিএফএল ল্যাম্প লাগানো হয়েছে। শহরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন সিপিএমের শহর জোনাল সম্পাদক অনিতবরণ মণ্ডল। ওই ওয়ার্ডে নিকাশির সমস্যা দীর্ঘদিনের। স্থানীয়দের দাবি, এলাকায় নর্দমার অভাব রয়েছে। এমনকী সংস্কারের অভাবে দুর্গামন্দির যাওয়ার পথের ধারের নর্দমাও মজে গিয়েছে। ভোটের মুখেই নর্দমা থেকে আবর্জনা তোলার কাজ হয়েছে। যদিও সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর সিপিএমের অনিতবরণ মণ্ডল বলেন, ‘‘আমি নিজে মনে করি ভোটের একেবারে আগে কাজ ঠিক নয়। আমি তাই এ ধরনের কাজ করিনি। পুরসভা যে টাকা বরাদ্দ করেছিল তা দিয়ে আগেই করে ফেলা কাজের বকেয়া মিটিয়ে দিয়েছি।’’
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পুরসভা বোর্ড মিটিং ডেকে শহরের উন্নয়নের জন্য প্রায় ৫ কোটি ৮০লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। এ ক্ষেত্রে ‘এ’ ক্যাটাগরির ২২টি ওয়ার্ডের প্রতিটির জন্য প্রায় সাড়ে ১৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। আর ‘বি’ ক্যাটাগরির ৪টি ওয়ার্ডের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১২লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেল এলাকার ৮টি ওয়ার্ডের জন্য ৯ লক্ষ টাকা করে বরাদ্দ হয়। আইআইটি-র ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের জন্যও ৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে পুরসভা। ভোটের মুখে এই টাকা ভোট প্রচারের কাজে ব্যয় হবে বলে আগেই অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। যদিও প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরেরা বরাদ্দ টাকা নিয়ে নেন। বিরোধী দলের কাউন্সিলরদের দাবি, ভোটের আগে পুরসভার বরাদ্দ অর্থ দিয়েই বিভিন্ন ওয়ার্ডে উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। যদিও এ বিষয়ে খড়্গপুরের বিদায়ী পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পাণ্ডে বলেন, “গত ফেব্রুয়ারিতে টাকা দিয়ে টেন্ডার করেছিলাম। গত ১৮ মার্চ নির্বাচন ঘোষণার আগে হওয়া ওয়ার্ক ওর্ডারে শুরু হওয়া কাজ চলতেই পারে। কিন্তু নতুন করে কোনও কাজ করা যায় না। এ বিষয়ে আমার কাছে নির্দিষ্ট অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখব।’’