শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন তরুণ রায়।
নাম বলছেন কেন, বদনাম বলুন। সচ্চি কথা করুন— নিজের ডেরায় বসে ফেলুদাকে বলেছিলেন মগনলাল মেঘরাজ।
ফুরফুরে মেজাজে থাকলে তাঁর ডেরা, জামশেদ আলি ভবনে (সিপিএমের কেশপুরের কার্যালয়) বসে তিনি বলতেন, ‘‘তোমরা ভাল বলতে পার, খারাপ বলতে পার। কিন্তু আমি পার্টির লোক। পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে চলি।’’ কেশপুরের সেই বিতর্কিত সিপিএম নেতা এন্তাজ আলি কলকাতার হাসপাতালে চারদিন রোগভোগের পর রবিবার রাতে প্রয়াত হলেন। লিভারের সংক্রমণে ভুগছিলেন। ছিল ডায়াবেটিস রোগ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক উপসর্গও। লোকসভা ভোট গণনার আগের দিন, গত বুধবার রাতেও ব্যস্ত ছিলেন এন্তাজ। গণনাকেন্দ্রে কারা এজেন্ট থাকবেন, তাঁদের ভূমিকা কী হবে সে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তারপর রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বছর বাষট্টির এন্তাজ। গণনার দিন ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে।
এন্তাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু মন্তাজ।
১৯৯৮-’৯৯ সাল। কেশপুর মানেই তখন বোমা-গুলির লড়াই। কোনও একদিন এমনই অশান্তিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কেশপুরের একটি অঞ্চল। খবর এল, এন্তাজ আলি আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বন্ধ হল বোমাবাজি। তিনি এলেন। আলোচনায় মিলল সমাধানসূত্র।
আদি বাড়ি কেশপুরের চরকায়। তবে পরিবর্তনের পর ২০১১ সাল থেকে ছিলেন ঘরছাড়া। গড়বেতার আরেক সিপিএম নেতা সুশান্ত ঘোষের সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল দাসেরবাঁধ কঙ্কাল-কাণ্ডে। প্রথমে আত্মগোপণ। পরে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন। থাকতেন মেদিনীপুর শহরে নিজের বাড়িতেই।
বড় কোনও পদ নয়। তবে তৎকালীন সিপিএমের কেশপুর তৎকালীন জোনাল কমিটির সদস্য এন্তাজের প্রভাব ছিল নিরঙ্কুশ। একবার হয়েছিলেন জেলা পরিষদের সদস্য। দু’ দফায় কেশপুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ (ভূমি)। একটা সময় ছিল যখন জামসেদ আলি ভবন আর এন্তাজ সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। জনশ্রুতি ছিল, জামশেদ আলি ভবনের অনুমতি ছাড়া নাকি কেশপুরে গাছের পাতাও নড়ে না। নামের উল্টোদিকে বদনাম। প্রভাবের উল্টোদিকে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ। বিরোধীদের অভিযোগ, সেসময় (১৯৯৮-’৯৯) কেশপুরে সব সন্ত্রাসের নেপথ্যে ছিলেন সাদা শার্ট আর কালো ট্রাউজার্স পরা মানুষটি। কেশপুরের হিংসা পর্বে এন্তাজের সঙ্গেই যাঁর নাম উঠে আসত সেই তৃণমূলের রফিক বলছেন, ‘‘ওর সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল। তবে ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল না। ওর পরিবারকে সমবেদনা জানাই।’’
এন্তাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু মন্তাজ।
২০১০ সাল। তখনও কেশপুর শুধুই লাল। এক জায়গায় রাস্তা নিয়ে গোলমাল চলছে। পার্টি অফিস থেকে বললেন, ‘‘আমি এন্তাজ আলি বলছি।’’ কিছুক্ষণের মধ্যে বন্ধ হল গোলমাল।
পেশায় স্কুলশিক্ষক। শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন কেশপুর এরিয়া কমিটির সদস্য। এক ছেলে এবং এক মেয়ে। সংসারের দায়িত্ব সামলাতেন তবে বেশিরভাগ সময় তাঁকে দেখা যেত জামশেদ আলি ভবনের একতলায়। ঘনিষ্ঠদের কেউ গেলেই আনাতেন চা, মুগের জিলিপি। সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণ রায় বলেন, ‘‘এই সময়টা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নতুন করে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর কাজ শুরু করেছি। এই সময়ে এন্তাজের মতো কমরেডের চলে যাওয়া আমাদের কাছে বড় ধাক্কা।’’
কেশপুরে ফের খুলছে সিপিএমের পার্টি অফিস। তা আর দেখে যাওয়ার সুযোগ হল না এন্তাজের। সোমবার মেদিনীপুরে সিপিএমের জেলা পার্টি অফিস, জামশেদ আলি ভবন হয়ে চরকায় পৌঁছল এন্তাজের নিথর দেহ।