ঝাড়গ্রামের সভায় মহিলাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। নিজস্ব চিত্র।
ভান্ডার ভরেছে লক্ষ্মীদের। ইভিএম ভরেছে শাসকের।
বিধানসভা ভোটে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পই যে তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল তা কার্যত স্বীকার করে নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে এ কথাও জানাতে ভুললেন না যে, এই প্রকল্প নিয়ে হিংসা করে বিজেপি। বৃহস্পতিবার ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে জেলার বুথ স্তরের তৃণমূল কর্মীদের সভায় মমতা বলেন, ‘‘যেহেতু বিজেপি জিততে পারেনি। আমাকে সরাতে পারেনি। লক্ষীর ভান্ডার দেখে ওদের হিংসে হয়।’’
বিধানসভা ভোটের আগেই এই লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন মমতা। ভোটের কথা ভেবে রাজকোষের কথা ভাবছেন না— লক্ষ্মীর ভান্ডারকে এ ভাবেই কটাক্ষ করেছিল বিজেপি-সহ বিরোধীরা। কিন্তু বিধানসভা ভোটের ফল বলছে, কাজে দিয়েছে প্রকল্প। মহিলারা উপুড়হস্ত হয়ে সমর্থন করেছেন মমতাকে। বিজেপি রাজ্য নেতারা আড়ালে-আবডালে স্বীকার করে নিয়েছেন, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের বিরুদ্ধে লড়ার মতো কোনও অস্ত্র ছিল না তাঁদের হাতে। মহিলাদের একটা বড় অংশের সমর্থন বরাবরই পেয়ে এসেছেন মমতা। লক্ষ্মীর ভান্ডারে তা আরও বেড়েছে। এ দিন তিনি বলেছেন, ‘‘মা-বোনেরা ছাড়া কোনও কাজ হয় না। ১১ বছরে সরকার পড়ল। ২০১১ সালে আপনাদের আশীর্বাদে, শুভেচ্ছা ও দোয়ায় ক্ষমতায় এসেছিলাম।’’ মহিলাদের ভোট যে তিনি কোনওমতেই হাতছাড়া করতে চান না তা স্পষ্ট হয়েছিল মঙ্গলবার ঝাড়গ্রামের প্রশাসনিক সভাতেও। বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ মামনি মুর্মু টেন্ডার নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিলেন পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ শুভ্রা মাহাতো ও জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ উজ্জ্বল দত্তের বিরুদ্ধে। উজ্জ্বলের উপর চোটপাট করার পর মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘কে শুভ্রা দেখি? মহিলা হয়ে এত লোভ?’’ অর্থাৎ কোনও মহিলা জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে জনমানসে যে ভুল বার্তা যায় তা বিলক্ষণ জানেন মমতাও।
মমতার পছন্দের কথা জানেন মন্ত্রী মানস ভুঁইয়াও। তাঁর উপরেই ঝাড়গ্রামের সভা সফল করার দায়িত্ব বর্তেছিল। এদিন দলীয় সভাতেও মা-বোনেদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। মমতা সভাস্থলে পৌঁছনোর আগে মন্ত্রী মানস মঞ্চ থেকে বার বার মাইক্রোফোনে মা-বোনেদের সামনের সারিতে বসার অনুরোধ করছিলেন। সভাস্থলে ঢোকার ক্ষেত্রে পুলিশের কড়াকড়ি নিয়েও সরব হন মানস। মানস পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘এত কড়াকড়ি করে চেকিং করলে মানুষের ঢুকতে সমস্যা হচ্ছে। বাইরে মা-বোনেরা স্ট্যাম্পেড হয়ে যাবেন। গেট গুলো খুলে দিন। সবাইকে আসতে দিন।’’ পরে অবশ্য জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কাতারে কাতারে লোকজনকে সভাস্থলে ঢোকানো হয়। এদিন সভার নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর বারোটা। মমতা সভা শুরু করেন প্রায় আধঘন্টা আগে ১১টা ৩৫ মিনিটে।
মমতাও সভাস্থলে মা-বোনেদের উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখে দৃশ্যতই খুশি হয়ে বলেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে টাকা অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে। সবাই পাচ্ছেন তো!’’ বারবার মা-বোনদের সঙ্গে কথা বলেছেন মমতা। সভা শেষে মমতা দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘মানুষের জন্য কাজ করবেন তো?’’ কিন্তু সমবেত স্বর জোরালো না হওয়ায় মমতা বলেন, ‘‘এত আস্তে বললে হবে না। মা-বোনেরা জোরে বলুন তো। ঝাড়গ্রামের মা-বোনেরা এতটাই শান্ত, তাঁরা সত্যিই লক্ষ্মী। তাঁরা একটুও জোরে কথা বলেন না। আমি কত জোরে কথা বলি দেখুন।’’ মা বোনেদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান, ‘‘ছেলেরা দুষ্টুমি করলে শাসন করবেন তো? মেয়েরা দুষ্টুমি করলে আমি শাসন করব। আর আমিও দুষ্টুমি করলে আপনারা আমাকেও শাসন করবেন।’’
এদিন সভায় আসা বেলপাহাড়ির বাসন্তী মাহাতো, নয়াগ্রামের সলমা কিস্কুরা বলছিলেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের ফলে আমরা স্বাধীনভাবে নিজেদের শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারছি। সেই কারণেই সভায় মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে এসেছিলাম।’’ সভাটি বুথ স্তরের কর্মীদের জন্য হলেও এদিন জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাসে করে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ বহু মানুষজনও সভায় এসেছিলেন। বন ও ক্রেতা সুরক্ষা প্রতিমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা এদিন সভার পরে বলছিলেন, ‘‘জঙ্গলমহলের মা-বোনেরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ। সংসার সামলানো মহিলাদের হাত খরচের জন্য স্বামী বা অভিভাবকের কাছে হাত পাততে হয় না। এই প্রকল্পের ফলে মহিলারাও আত্মসম্মানের জায়গাটাকে অনুভব করতে পারছেন।’’
ভান্ডার ভরে লক্ষ্মীদের আগলে রাখছেন ‘দিদি’।