ভোট-যুদ্ধে এ বার কি নিয়তি, জল্পনা

কয়েকদিন আগে পুরনো একটি মামলায় ঝাড়গ্রাম আদালতে হাজির হয়েছিলেন জনগণের কমিটির জেলবন্দি নেতা ছত্রধর মাহাতো। ওই দিন স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে এসে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলেছিলেন নিয়তিদেবী।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৬ ০১:৪৫
Share:

ছত্রধর মাহাতো (বাঁ দিকে), নিয়তি মাহাতো (ডান দিকে)।—ফাইল ছবি।

কয়েকদিন আগে পুরনো একটি মামলায় ঝাড়গ্রাম আদালতে হাজির হয়েছিলেন জনগণের কমিটির জেলবন্দি নেতা ছত্রধর মাহাতো। ওই দিন স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে এসে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলেছিলেন নিয়তিদেবী। তারপরই জঙ্গলমহলের আনাচে কানাচেতে গুঞ্জন, জেলবন্দি কমিটি-নেতার স্ত্রী নিয়তি মাহাতো কী তাহলে এবার ভোটের ময়দানে লড়াইয়ে নামবেন! নিয়তিদেবী অবশ্য সরাসরি জবাব দেননি। তবে আনন্দবাজারকে তিনি জানাচ্ছেন, “ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।”

Advertisement

সেজন্যই কী স্বামীর সঙ্গে একদফা শলাপরামর্শ করেছেন? মুচকি হেঁসে নিয়তিদেবীর জবাব, “সাড়ে ছ’বছর ধরে মানুষটা জেলবন্দি। তবে সংসারের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়ে ওঁর সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।” ছত্রধরের আইনজীবী কৌশিক সিংহ অবশ্য জানাচ্ছেন, “গতবার ছত্রধর ছিলেন বিচারাধীন বন্দি। তাই তিনি ভোটে লড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন সাজাপ্রাপ্ত ছত্রধর ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। তাই আমার মক্কেল তাঁর স্ত্রীকে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্মতি দিয়েছেন।”

সূত্রের খবর, এ বার ঝাড়গ্রাম বিধানসভা আসনে ছত্রধরের স্ত্রী নিয়তিদেবীকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য আলোচনা শুরু করেছেন জনগণের কমিটির প্রাক্তনীদের একাংশ। জনগণের কমিটির প্রাক্তন নেতা মনোজ মাহাতো প্রকাশ্যে অবশ্য বলছেন, “ভোটে দাঁড়াতে গেলে অনেক রকম প্রস্তুতির প্রয়োজন। নিয়তিবৌদি প্রার্থী হচ্ছেন বলে আমার কাছে এখনও কোনও খবর নেই।”

Advertisement

যদিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছত্রধরের পুরনো সঙ্গীদের একাংশ মনে করছেন, ভোট প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে শাসক তৃণমূলের উন্নয়নের দাবির ফানুস ফুটো করে দেওয়া দরকার। ওই মহলের মতে, জঙ্গলমহলে ছত্রধরের নেতৃত্বে জনগণের কমিটির উত্তুঙ্গ আন্দোলন না হলে তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেত না। এক সময় লালগড়ের খাসজঙ্গলে ছত্রধরকে নিয়ে একসঙ্গে সভা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছত্রধরের স্বজন-পরিজনদের অভিযোগ, মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ছত্রধরের সঙ্গে ন্যায় বিচার করা হয়নি। ছত্রধরের এক সময়ের সঙ্গীরা অনেক আগেই জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। শাসকদলে নাম লিখিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন তাঁরা। অথচ ইউএপিএ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ছত্রধর এখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে সাজাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বন্দি। নিয়তিদেবীরও প্রশ্ন, “এই যে এত উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, আমার স্বামী আন্দোলন না করলে
এসব হত?”

উন্নয়নের এই বিষয়টি নিয়ে ভোট-মরসুমে পাল্টা প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন ছত্রধরের ঘনিষ্ঠ মহল। এবং প্রাসঙ্গিক ভাবে ছত্রধরের জনসমর্থন যাচাই করারও সুযোগ রয়েছে এই নির্বাচনে। ছত্রধরের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, ২০১১-র ভোটের সময় তৃণমূলের তরফে সুনির্দিষ্ট কোনও আশ্বাস না পেয়ে জেল থেকে ঝাড়গ্রাম আসনে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন ছত্রধর। গতবার ছত্রধরের হয়ে প্রচার করেছিলেন নিয়তিদেবী। যদিও মাত্র ২০,০৩৭ টি ভোট পেয়েছিলেন কমিটি-নেতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গতবার ছত্রধর নির্দল হিসেবে দাঁড়ানোয় তৃণমূলের প্রার্থী সুকুমার হাঁসদারই সুবিধা হয়েছিল। ছত্রধর ভোট কাটার ফলে সুকুমারবাবুর জয় সহজ হয়েছিল। কিন্তু ছত্রধরের ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, গতবার পরিবর্তন ঝড় ছিল। পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। গত নির্বাচনগুলিতে আদিবাসী ভোটের বড় অংশ শাসক দলের অনুকূলে গিয়েছিল। রাজ্যের এবং বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতস্তরের ক্ষমতা দখলের পরে তৃণমূল এখন পরীক্ষিত রাজনৈতিক দল। শাসক দলের নিচুতলায় নানা ক্ষোভ বিক্ষোভ ও তুমুল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে। ফলে, অন্তত জনমত যাচাইয়ের জন্য এবার ভোটে নিয়তিদেবীর প্রার্থী হওয়াটা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন ছত্রধরের সমর্থকরা।

এমন গুঞ্জনে অবশ্য তৃণমূল শিবিরেও কিছুটা অস্বস্তি শুরু হয়েছে। ঝাড়গ্রাম আসনে এবারও তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন আদিবাসী উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা। কিন্তু সুকুমারবাবুকে নিয়ে দলের অন্দরে ব্যাপক ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে। ঝাড়গ্রাম আসনে সিপিএম প্রার্থী দেয়নি। আর ঝাড়গ্রাম আসনের কথা জানিয়েছে কংগ্রেস। ওই আসনে সিপিএমের সমর্থনে কংগ্রেসের পুরনো জোটসঙ্গী ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর নেত্রী চুনিবালা হাঁসদা প্রার্থী হতে চাইছেন। ফলে, নিয়তিদেবী প্রার্থী হলে ভোট কেটে কার লাভ হবে সেই জটিল অঙ্কের সমাধান সহজ নয়।

নিয়তিদেবী প্রার্থী হলে তৃণমূলের ভোটেই তিনি ভাগ বসাতে পারেন, এমন আশঙ্কায় ছত্রধরের পরিবারের মন পাওয়ার জন্য তত্‌পর হয়েছেন স্থানীয় তৃণমূলের একাংশ। ছত্রধরের বৃদ্ধা মা বেদনবালাদেবীকে বার্ধক্য ভাতা দেওয়ার জন্য প্রশাসনিকস্তরে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। লালগড় ব্লক তৃণমূলের সভাপতি বনবিহারী রায়ের মন্তব্য, “ছত্রধর কোনও ফ্যাক্টর নয়। ওদের সবাই এখন আমাদের দলে ঢুকে গিয়েছে।” নিয়তিদেবী অবশ্য মুখ ঝামটা দিয়ে বলছেন, “গত পাঁচ বছরে তো কেবল অসহযোগিতায় পেয়ে এসেছি। এখন ভোটের আগে ওসব প্রলোভনে ভুলছি না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement