গ্রাম ভোলেনি বীরাঙ্গনাদের

কোনও দোষ থাকে না। তবুও ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে মানসিক এবং সামাজিক ভাবে কুঁকড়ে থাকেন নির্যাতিতা। তাঁদের পরিবার। কিন্তু মেদিনীপুরের তিনটি গ্রাম ব্রিটিশ পুলিশের গণধর্ষণে কুঁকড়ে যায়নি। পাশে দাঁড়িয়েছিল নির্যাতিতাদের। ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। সেই তিন কৃতী গ্রামের কথা লিখলেন হরিপদ মাইতিদারোগা নলিনীকে দেখেই আতঙ্কটা বেশি পেয়ে বসেছিল গাঁয়ের মানুষগুলোর। গেঁওখালি ঘাঁটির দারোগা নলিনী রাহার আগে ‘ঘরপোড়া’ বিশেষণটা শুধু শুধু যোগ হয়নি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৮ ০২:৪৪
Share:

দৃষ্টান্ত: ছুরিকা বাহিনীকে সম্মান জানিয়ে তৈরি হয়েছে স্মারক। মহিষাদলের লক্ষ্যায়। ছবি: আরিফ ইকবাল খান

দিনটা আর পাঁচটা দিনের থেকে আলাদা কিছু ছিল না। অন্তত সকাল ৯টা পর্যন্ত ছিল না। মহিষাদলের পুবদিকে তিনটি নিস্তরঙ্গ গ্রাম, মাশুড়িয়া, ডিহি মাশুরিয়া এবং চণ্ডীপুরে সেদিন ছিল এক জড়সড় শীতের সকাল। আড়মোড়া ভেঙে সবে শুরু হয়েছিল দিনের কাজকর্ম। গাঁয়ের পুরুষেরা কাস্তে হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে মাঠে চলে গিয়েছেন। মেয়েরা ব্যস্ত ঘরের কাজে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কেউ রোদে পিঠ দিয়ে পড়ছে। কেউ রোদ পোয়াচ্ছে বাড়ির উঠোনে। রোজকারের চেনা ছকটা ভেঙে গেল সকাল ৯টা নাগাদ। চারদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল হঠাৎই। সকলে সচকিত। দলে দলে পুলিশ ঢুকছে গ্রামে। এসব গ্রামে এত পুলিশ আগে কখনও আসেনি! তিনটে গ্রাম ঘিরে ফেলেছে প্রায় ছ’শো ব্রিটিশ পুলিশ। সেই দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে দারোগা ঘরপোড়া নলিনী।

Advertisement

দারোগা নলিনীকে দেখেই আতঙ্কটা বেশি পেয়ে বসেছিল গাঁয়ের মানুষগুলোর। গেঁওখালি ঘাঁটির দারোগা নলিনী রাহার আগে ‘ঘরপোড়া’ বিশেষণটা শুধু শুধু যোগ হয়নি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দমনের নামে অজস্র ঘরবাড়ি পুড়িয়ে কুখ্যাত নলিনী দারোগা। নলিনী এত পুলিশ নিয়ে কেন গ্রামে ঢুকেছে? দ্রুত মাঠ থেকে ছুটে এলেন পুরুষেরা। তাঁরা জানতে চাইলেন, কী ঘটেছে? কিন্তু তাঁদের কাউকে বাড়ির কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হল না। প্রবল ভাবে মারধর করে দূরে সরিয়ে দেওয়া হল তাঁদের। তারপর ঘরে ঢুকল পুলিশ। শুরু হল তাণ্ডব। তল্লাশির নামে শুরু হল শুরু হল ভাঙচুর, লুঠপাট।

১৯৪৩ সালের ৯ জানুয়ারি। সেদিন তিনটে গ্রামে ঘরবাড়ি লুঠের সঙ্গে লুঠ হয়ে গেল ৪৬ জন মহিলার সম্ভ্রম। পুলিশের গণধর্ষণের শিকার হলেন তাঁরা। একেকজন অনেকবার। চারবার পর্যন্ত। সারা অগস্ট আন্দোলনে তমলুক মহকুমায় ধর্ষিতা হয়েছিলেন ৭৩ জন। কিন্তু ৯ জানুয়ারি একদিনে, বলা ভাল একবেলায় নির্যাতনের শিকার হলেন ৪৬ জন। তিনটি গ্রামের মধ্যে মাশুড়িয়ায় নির্যাতিতার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, ২৩ জন। চণ্ডীপুরে ১২ জন এবং ডিহি মাশুড়িয়ায় ১১ জন। নির্যাতিতাদের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছর। শুধুমাত্র কুসুমকুমারী বেরা এবং কিরণবালা শীটের বয়স ছিল ৩২ বছর। দু’জনেই মাশুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা। সেদিন পুলিশ অন্তঃসত্ত্বা এবং স্বামীহীনাদেরও ধর্ষণ করে। চণ্ডীপুরের অধরচন্দ্র মাইতির স্ত্রী সিন্ধুবালার বয়স ছিল ২১ বছর। পরপর তিনজন তাঁকে ধর্ষণ করে। অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ঘটনার ন’দিন পরে মারা যান সিন্ধুবালা।

Advertisement

ব্রিটিশ পুলিশ সেই সময়ে সাম্রাজ্য বিরোধী আন্দোলন ভাঙতে চাইছিল। লবণ সত্যাগ্রহ, অগস্ট আন্দোলন, থানা দখল আন্দোলন, জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে আক্রোশ, সব কিছু আটকাতেই পুলিশ নির্যাতনকেই বেছে নিয়েছিল। পুলিশের সেই অস্ত্রেরই শিকার হয়েছিলেন কাঁথির পদ্মাবতী দাসী। দুধ বিক্রি করতেন তিনি। পিছাবনিতে লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। সেই সময়ে পুলিশ তার উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। গোপনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। পদ্মাবতীর মতো ৭৩ জন মহিলা সেই সময়ে অসহনীয় অত্যাচারের ইতিহাস বহন করে বেড়াচ্ছিলেন সেই সময়ে। কিন্তু একবেলার মধ্যে ৪৬ জনের ধর্ষণ নাড়িয়ে দিল মেদিনীপুরকে। নাড়িয়ে দিল গাঁধীজিকে।

মাশুড়িয়ার ঘটনায় স্বাধীনতা আন্দোলনের অভিমুখ বদলে দিয়েছিল সেই সময়ে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশে সামাজিক এবং রাজনৈতিক নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমন নৃশংস ঘটনায় বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন তমলুকের নেতৃবৃন্দ। গণপতিনগরে এক সভায় বাকরুদ্ধ হয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের কথা ভেবেছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয়কুমার মুখোপাধ্যায় এবং সুশীলকুমার ধাড়ার মতো নেতৃবৃন্দ। কিন্তু সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার পরে তাঁরা আন্দোলন আরও শক্তিশালী এবং সহিংস করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই অত্যাচারীদের শাস্তি দিতে শপথ নিলেন তাঁরা। সেই শপথের কাঠিন্য ইতিহাসে লেখা। অমিত বিক্রমে গঠিত হয়েছিল জাতীয় সরকার। গাঁধীজির নির্দেশে সরকার ভেঙে দিতে না হলে ইতিহাস হয়তো অন্য ভাবে লেখা হতো।

১৯৪২ সালের ১৯ অক্টোবর মাশুড়িয়া গ্রামের কাছে দ্বারিবেড়িয়া গ্রামে সুবোধবালা কুইতির নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল ভগিনীসেনা। বিদ্যুৎবাহিনী এবং ভগিনীসেনাকে জাতীয় সরকারের সেনাবাহিনী হিসেবে গ্রহণ করা হয়।। মাশুড়িয়ার ঘটনার পরে মেয়েদের আত্মরক্ষার ওপরে জোর দেওয়া হয়। স্থানীয় কামারদের দিয়ে তৈরি করা হয় ১০ হাজার ছোরা। সেগুলো বিলি করা হয় মেয়েদের মধ্যে। নির্যাতনের ঘটনার পরে ২১ জানুয়ারি মেদিনীপুরের প্রাক্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বি আর সেন দু’জন আইসিএস অফিসার এবং দু’জন দেহরক্ষী নিয়ে মাশুড়িয়া গ্রামে যান। মাত্র তিনজনের জবানবন্দি নিয়ে তিনি কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ওই তিন মহিলা দাবি করেন, বাকি মেয়েদেরও জবানবন্দি নিতে হবে। বি আর সেন বলেছিলেন, ‘আর দরকার নেই, যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছি’। সেই সময়ে মেয়েরা ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘিরে ফেলেছিলেন। প্রত্যেকে কাপড়ের আড়াল থেকে ধারাল ছোরা বার করে দেখান তদন্তকারীদের। জানিয়ে দেন, ব্রিটিশ পুলিশ যে নিরস্ত্র, অসহায় মেয়েদের উপরে যে অত্যাচার করেছে তা আর হতে দেবেন না তাঁরা। আবার যদি তারা গ্রামে ঢোকে তবে প্রাণ নিয়ে ফিরবে না। নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে তাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিতে তৈরি। মাশুড়িয়ার ঘটনাই রুখে দাঁড়াতে প্রেরণা দিয়েছিল মেয়েদের। কুমুদিনী ডাকুয়া এবং গিরিবালা ছুরি দেখিয়ে মাঝরাতে ব্রিটিশ পুলিশকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন।

ফজলুল হক মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগের অন্যতম কারণ ছিল মেদিনীপুরে অমানুষিক অত্যাচার এবং নারীত্বের চরম অবমাননা। তাঁর পদত্যাগে মন্ত্রিসভা দুর্বল হয়ে পড়ে। পরে অবশ্য মন্ত্রিসভার পতনও হয়। এই ঘটনার পরোক্ষ প্রভাবে গাঁধীজিকে ১৯৪৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর মহিষাদলে এসে পাঁচদিন অবস্থান করতে হয়েছিল। তিনি আভা গাঁধী এবং সুশীলা নায়ারকে নির্যাতিতা মেয়েদের কাছে পাঠিয়ে ঘটনার বিবরণ নেন। আভা এবং সুশীলার কাছ থেকে অত্যাচারের কাহিনি শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন গাঁধীজি। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাঁর উচ্চারণ, ‘বর্বর’।

মাশুড়িয়া ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গাঁধীজিকেও সহিংস আন্দোলনে পরোক্ষে সমর্থন দিতে হয়েছিল। সুশীল ধাড়া, সতীশ সামন্তের সহিংস আন্দোলন নিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা যা করেছ বীরোচিত। তবে তোমরা অহিংসার পথে থাকলে ভাল হত’।

কিন্তু মাশুড়িয়ার ঘটনার একটা সামাজিক প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। যা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে যুগান্তকারী। তিনটি গ্রামের প্রতিটি নির্যাতিতাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ঘরে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন আপনজনেরা। মেয়েকে, বোনকে, স্ত্রীকে। এখনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে নির্যাতিতার পরিচয় গোপন রাখা হয় সংবাদমাধ্যমে। তাঁদের সামাজিক ভাবে অপদস্থ হওয়ার আশঙ্কায়। অথচ সেই নির্যাতনে তাঁদের কোনও দোষ থাকে না। সেই সময়ে মাশুড়িয়া, ডিহি মাশুড়িয়া এবং চণ্ডীপুরের মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রত্যেক নির্যাতিতার। সহমর্মী হয়ে, পাশে থেকে তাঁদের মনের ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা করেছেন।

সমালোচনা যে হয়নি তা নয়। ২৫ জানুয়ারি ‘বিপ্লবী’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে অজয়কুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘লজ্জায় মরিয়া যাইতে ইচ্ছা করে, গ্রামবাসী পুরুষদের আচরণ দেখিয়া। শত্রুসৈন্য আক্রমণ করিলে যেসব পুরুষ নিজেদের মা-বোনকে অসহায় অবস্থায় ফেলিয়া রাখিয়া পলাইয়া আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে—তাহাদিগকে বা মানুষ বলি কি করিয়া’? কিন্তু বিশাল সংখ্যক সশস্ত্র পুলিশের সামনে তাঁদেরই বা কী করার ছিল? সেটাও ভেবে দেখার।

ফিরে যাওয়া যাক ৯ জানুয়ারির সেই শীতের সকালে। পুলিশ চলে গেল। ফিরে এলেন পুরুষেরা। পুরো গ্রাম থমথমে। আপনজনদের দেখে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করেন। ভেঙে পড়েন অনেকে। নিকটজন এবং বৃহত্তর সমাজ নতমস্তকে মেনে নিয়েছিল তাঁদের মেয়েদের রক্ষা না করতে পারার অক্ষমতাকে। কিন্তু কাউকে ছেড়ে যাননি। আর মেয়েরাও পুরুষদের পাশে নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে।

বছর তিনেক আগে মারা গিয়েছেন নির্যাতিতাদের শেষজন, কাননবালা মাইতি। নির্যাতনের সময়ে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। বীরাঙ্গনাদের উত্তরসূরিরাও মনে করেন, তাঁদের পরিবারের মেয়েরা স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত। শরীরের আর মনের সব ক্ষত নিয়েই বীরাঙ্গনারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতের এক নাগরিক হিসেবে সেই বীরাঙ্গনাদের অভিবাদন। সজল অভিবাদন।

লেখক মহিষাদল রাজ কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement