Torture house turned into school

পরিত্যক্ত নীলকুঠিতে গড়ে ওঠে বিদ্যালয়

অশ্বত্থ গাছের তলায় চাটাই বিছিয়ে পথ চলা শুরু হয়েছিল। গ্রামবাসীরা আন্তরিক ভাবে এগিয়ে আসেন। বাড়ি তৈরির ইট দিয়েছিলেন কেউ। মালবান্দি আশুতোষ বিদ্যামন্দিরের।

Advertisement

রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৫০
Share:

মালবান্দি আশুতোষ বিদ্যামন্দির। নিজস্ব চিত্র।

দরকার ছিল স্কুলের। কিন্তু হবে কোথায়? উপায় খুঁজে পান গ্রামবাসীরা। এলাকায় রয়েছে পরিত্যক্ত এক নীলকুঠি। যে কুঠিতে এক সময় চাষিদের আটকে রেখে অত্যাচার করত নীলকরেরা। গ্রামবাসীরা ঠিক করলেন, ওই অত্যাচারের চিহ্নবাহী নীলকুঠিতেই তৈরি হবে নতুন স্কুল। চাষিদের আর্তনাদের ইতিহাসের সঙ্গেই স্থাপিত হবে শিক্ষার কীর্তিশালা।

Advertisement

গড়বেতা-১ ব্লকের খড়কুশমা অঞ্চলের মালবান্দি গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপনের চেষ্টা শুরু হয়েছিল। বিদ্যালয়ের নথি বলছে, বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ করেন এলাকার ২০টি গ্রামের মানুষ। মালবান্দিকে কেন্দ্র করে এই ২০টি গ্রাম হল জান্দা, লোধা, সিমুলিয়া, বিরাজপুর, বলদঘাটা, দুবরাজপুর, বৃকভানুপুর, রাজবল্লভপুর, হরিপুর, কীর্তনবাড়, ইটাচাঁদ, লাউমারা, ঘোড়ামারা, গড়বেড়িয়া, ঢলমা, কদমবান্দি, আনন্দনগর, চান্দাবিলা, গামারকুশি ও গোপালপুর। গ্রামগুলোর বাসিন্দারা সিদ্ধান্ত নেন ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় জরুরি। শিলাবতী নদী অববাহিকায় এই এলাকা। তখন বিদ্যালয় ছিল সন্ধিপুর, মঙ্গলাপোতা বা চন্দ্রকোনার মহেশপুরে। শুধু দূরবর্তী নয়, নদী, জঙ্গল পার করে বিপদ সঙ্কুল পথ। প্রাথমিকের পরে ছেলে মেয়েদের অত দূরের বিদ্যালয়ে পাঠাতে তেমন আগ্রহ দেখাতেন না অভিভাবকেরা।

কী ভাবে তৈরি হল স্কুল? মালবান্দিতে একটি নীলকুঠি ছিল। আর তা ছিল ব্রিটিশ শোষণ ও শাসনের একটি কেন্দ্রস্থল। ১৯৬৫ সালে ২০টি গ্রামের বাসিন্দারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন সেই নীলকুঠি সংস্কার করে বিদ্যালয় গড়া হবে। প্রথম এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রাধারমণ জানা। বিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব স্মরণিকায় তাঁর লেখা একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নীলকর সাহেবরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ে মালবান্দির নীলকুঠিটি স্থানীয় জমিদার ব্যোমকেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিক্রি করেন। জমিদারের কাছ থেকে নীলকুঠিটি কিনে নেন স্থানীয় বাসিন্দা মুকুন্দচরণ মাইতির ছেলে শশাঙ্কশেখর মাইতি। গ্রামবাসীদের প্রস্তাবে সায় দিয়ে তিনি বিদ্যালয়ের জন্য নীলকুঠিটি স্বেচ্ছায় দান করেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যেহেতু নীলকুঠিতে বিদ্যালয় হবে, সে জন্য এর নামকরণ হবে ‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামে। যিনি নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন।

Advertisement

শুরু হয় ঝোপজঙ্গল কেটে পরিত্যক্ত নীলকুঠি পরিষ্কার করা হয়। গ্রামে গ্রামে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ চলে। সব কাজে এগিয়ে আসেন এলাকার বাসিন্দারা। সকাল থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজে বেরোতেন তাঁরা। গভীর রাত পর্যন্ত চলত সেই কাজ। প্রায় এক দেড় বছর ধরে চলে তহবিল গড়ার কাজ। এরই মধ্যে ১৯৬৭ সালের ২ জানুয়ারি থেকে অস্থায়ী ভাবে শুরু হয়ে যায় বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন। শুরু হয় টু ক্লাস জুনিয়র হাইস্কুল, অর্থাৎ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির বিদ্যালয়। প্রধানশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করা হয় গড়বেতার মোলডাঙা গ্রামের খগেন্দ্রনাথ আদককে। দু’জন সহ-শিক্ষক, একজন করণিক ও একজন পিওন নিয়োগ করা হয়। একদিকে বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু, অন্যদিকে অর্থ সংগ্রহ— দু’টোই চলতে থাকে।

বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধানশিক্ষক খগেন্দ্রনাথ আদক বলেন, "১৯৬৭ সালের ২ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিল বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন। এখনও মনে আছে মালবান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে অশ্বত্থ গাছের তলায় চাটাই বিছিয়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির
৬২ জন ছাত্র ছাত্রীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল বিদ্যালয়।" এক স্মরণিকার তথ্য বলছে, শশাঙ্কশেখর মাইতি নীলকুঠি দান করেন। সেখানে দু’টি শ্রেণিকক্ষ এবং একটি অফিস ঘর নির্মাণের জন্য উদ্যোগ করেন এলাকাবাসী। নিজেদের বাড়ি তৈরির জন্য ভাটা করে ইট করেছিলেন রাধারমণ জানার বাবা অধরচন্দ্র। বিদ্যালয়ের জন্য সেই ইট দান করেছিলেন তিনি। রাধারমণ জানা স্মরণিকায় লিখছেন, 'বাবা রাজি হওয়ার পরেরদিনই কুড়িখানা গ্রামের প্রায় আড়াইশো গরুর গাড়ি এসে দু’টি ভাটা থেকে ইঁট তুলে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ফেলল। সেই ইঁট দিয়েই স্কুল বাড়ির প্রথম দিকের প্রায় সমস্ত কাজ সম্পন্ন হল। স্কুলবাড়ি নির্মাণের জন্য বাবার এই ইঁটদানের কথা দেশবাসীরা (এলাকাবাসী) আজো কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে’। বিদ্যালয় নির্মাণে মুকুন্দচরণ মাইতি স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে টাকা দিলেন। তিনি স্থানীয় লোধা মৌজায় ১০ বিঘা জমিও বিদ্যালয়কে দান করেন। শুরু হয় বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ নির্মাণের কাজ।

বিদ্যালয়ের জন্য জমিদান করেন অনেকে। গোয়ালতোড়ের হুমগড়ের বাসিন্দা কুন্দবালা দেবী বিদ্যালয় সংলগ্ন জান্দা মৌজায় ৩.০৯ একর জমি দেন। যেটি খেলার মাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বলদঘাটা গ্রামের বাসিন্দা জ্ঞানদা মানা ২.৫০ বিঘা জমি দান করেন। জান্দা গ্রামের প্রমথনাথ মাজি ১০ কাঠা জমি দেন। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় নীলকুঠি সংস্কার-সহ আরও কয়েকটি ঘর ইটের দেওয়াল আর ছাদ ঢালাই করে গড়ে তোলা হয়।

১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে বিদ্যালয়টি টু ক্লাস জুনিয়র হাইস্কুলের সরকারি অনুমোদন পায়। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র হাইস্কুলের অনুমোদন মেলে ১৯৭৪ সালে। ১৯৮৭ সালে নবম ও দশম শ্রেণির পঠনপাঠনের অনুমোদন পায়। ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত হয়। এলাকার মানুষ এখনও নানাভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ২০১৭-১৮ সালে বিদ্যালয়ে পালিত হয় সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। তখন বাসিন্দারা নানা ভাবে সাহায্য করেন। অর্থ দিয়ে, শ্রম দিয়ে। রাজবল্লভপুর গ্রামের গণেশ ধাওয়া আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আবক্ষ মূর্তি বসাতে আর্থিক সহযোগিতা করেন। এই গ্রামের বৃদ্ধা মেনকা মাইতি আর্থিক সাহায্য করেন বিদ্যালয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি বসাতে।

প্রাক্তনী রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি বলেন, "শিক্ষার প্রসারে অনেকগুলো গ্রামের মানুষ উদ্যোগ করে মালবান্দি আশুতোষ বিদ্যামন্দির গড়ে তুলেছিলেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরনো এই বিদ্যালয় এখন এলাকাবাসীর গর্ব। ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করা এই শিক্ষাঙ্গনকে এখনও বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন তাঁরা।" সুবর্ণজয়ন্তী স্মরণিকায় প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক বনমালী মাইতি লিখছেন, 'যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে অবস্থান এই বিদ্যালয়ের। অনেকগুলো গ্রামের কিছু মানুষের আত্মত্যাগ এবং অনুভূতি দিয়ে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়টির অভ্যন্তরে এখনও রয়েছে অনেক অভাব’। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক রাজা রায় বলেন, "বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে এলাকাবাসীর অবদান ভোলার নয়।"

পরিচালন কমিটির সভাপতি গৌর সরকেল বলেন, "সবার সহযোগিতায় বিদ্যালয়ে অনেক কিছুই হয়েছে। ছাত্র ছাত্রীদের স্বার্থে আরও কিছু কাজ যেমন, ঘূর্ণিঝড় ফণী ঝড়ে গাছ পড়ে ভেঙে যাওয়া বাউন্ডারি দেওয়ালের একাংশ মেরামত করা, স্কুল ক্যাম্পাসে বাতিস্তম্ভ বসানো, অসম্পূর্ণ অডিটোরিয়ামের কাজ সম্পূর্ণ করা আশু প্রয়োজন। দরকার আরও শিক্ষক।"

বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রী ৭৮০ জন। ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক বিবেক মাইতি বলেন, "এলাকার মানুষের সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের অগ্রগতি অব্যহত। নীলকুঠির বিদ্যালয় থেকে এখন অন্যান্য বিল্ডিংও হয়েছে। মুক্তমঞ্চ, সাইকেল স্ট্যান্ড, স্মার্ট ক্লাসরুম, সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প, সাবমার্সিবল জল পাম্প, সিসি ক্যামেরায় নজরদারির ব্যবস্থা, মাল্টিজিম, লাইব্রেরি, স্যানিটারি প্যাডের ভেন্ডিং মেশিন বসেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে কৃতীদের পুরস্কার দেওয়া, বৃত্তিমূলক পাঠদান, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তথা সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে ছাত্র ছাত্রীদের অংশ গ্রহণে বিদ্যালয়ের গরিমা বেড়েছে ক্রমেই।"

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement