স্বীকার করছেন জেলা নেতাদের একাংশ

সোনার বালি চুরি কাণ্ডে নাম শাসকের

বালি আর বালি নেই, সোনা হয়ে গিয়েছে। শিলাবতী নদীর পাড়ে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে সেই গল্প। বলছেন দিন মজুর থেকে সাধারণ মানুষ— সকলেই। সোনালি বালুর চর ক্রমশ যেন খাঁটি সোনা হয়ে উঠছে। পিছনে ছুটছে বিরাট চক্র। মদত মিলছে শাসকদলের ছোট, বড়, মাঝারি— নানা মাপের নেতার।

Advertisement

অভিজিৎ চক্রবর্তী

ঘাটাল শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৭ ০১:৩৫
Share:

বালি-চুরি: শিলাবতী নদী থেকে উঠছে বালি। ছবি: কৌশিক সাঁতরা

বালি আর বালি নেই, সোনা হয়ে গিয়েছে। শিলাবতী নদীর পাড়ে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে সেই গল্প। বলছেন দিন মজুর থেকে সাধারণ মানুষ— সকলেই। সোনালি বালুর চর ক্রমশ যেন খাঁটি সোনা হয়ে উঠছে। পিছনে ছুটছে বিরাট চক্র। মদত মিলছে শাসকদলের ছোট, বড়, মাঝারি— নানা মাপের নেতার।

Advertisement

অভিযোগ যে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, জানালেন পশ্চিম মেদিনীপুরের একাধিক তৃণমূল নেতা। খোদ জেলা সভাপতি অজিত মাইতি স্বীকার করে নিয়েছেন অবৈধ বালি ব্যবসায় মদত দেওয়ার বিষয়ে কিছু নেতা সম্পর্কে অভিযোগ এসেছে।

জেলা প্রশাসনের একটি সূত্রের খবর, নোহারি, খড়কুসমা, ধাদিকা, বোড়াই, গনগনি, পায়রাগোড়া, বীরাজপুর, সন্ধিপুর-সহ শিলাবতীর অসংখ্য নদী ঘাট থেকে দিনে-দুপুরে লুঠ হচ্ছে বালি। নদীতে জেসিবি মেশিন নামিয়ে রাতের অন্ধকারেও বালি তুলে নিয়ে যাচ্ছে শ’য়ে শ’য়ে কয়েক বছর আগেও এ সব বালি বিকোতো জেলাতেই। এখন অবশ্য সবচেয়ে বেশি চাহিদা কলকাতায়। সেখানকার ইমারত ব্যবসায়ীরা মোটা টাকায় কিনে নিচ্ছেন লরি লরি বালি।

Advertisement

বালির ব্যবসায় জড়িত এক ব্যক্তি জানালেন, এক একটি লরিতে প্রায় ২৫০-৩০০ ঘন ফুট বালি ধরে। জেলায় ১০০ ঘনফুট বালি বিক্রি হয় ২৫০০-৩০০০ টাকায়। তার উপর পরিবহণ খরচ যোগ করে এক এক লরি বালি বিক্রি হয় প্রায় হাজার দশেক টাকায়। কিন্তু কলকাতায় নিয়ে গেলে সেই পরিমাণ বালিই বিক্রি হয়ে যায় ৩০-৩৫ হাজার টাকায়। ‘‘কলকাতায় পরিবহণ খরচ বেশি হলেও যা দাম পাওয়া যায় তাতে ভালই লাভ থাকে। তা ছাড়া, কোনও মূলধনের প্রয়োজনও হচ্ছে না। শুধু শাসকদলের নেতাদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেই হল। প্রশাসনকেও লাভের একটা অংশ দিতে হচ্ছে।”, সাফ জানালেন ওই ব্যবসায়ী।

শাসকের প্রত্যক্ষ মদতের কথা শুনে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই ওই সব নেতাদের সতর্কও করা হয়েছে। দলীয় ভাবে গোপনে তদন্তও শুরু হয়েছে।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের জেলার কোর কমিটির এক সদস্যও বলে ফেললেন, “খোদ দলনেত্রীর কানেও বিষয়টি গিয়েছে।” এই অবৈধ কারবারে কে নেই! দলেরই এক নেতার কথায়, “দলের বুথ সভাপতি থেকে পঞ্চায়েত-পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য, জেলা পরিষদের সদস্য থেকে ব্লক ও জেলা কমিটির নেতা— সকলেই জড়িত।”

বাস্তব হল, যে ভাবে বালির কারবার চলছে তাতে সরকারের রাজস্বের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে পরিবেশ। নদীর পাড় থেকে গ্রামীণ রাস্তা, কৃষি জমি— ক্ষতি সব কিছুর। নদীপাড়ের বাসিন্দাদের দাবি, তাঁরা বহু আন্দোলন করেছেন। বহু গাড়ি আটকে পুলিশেও খবর দিয়েছেন। এখন আর সাহস পান না। একই সঙ্গে চলছে শাসকদলের হুমকি আর বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য। ফলে আন্দোলন প্রায় বন্ধ ।

পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক জগদীশ প্রসাদ মিনা বলেন, “জেলার বেশ কিছু বালি খাদানকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অবৈধ বালি তোলার বিরুদ্ধে বিএলআর, বিডিও-সহ পুলিশ একযোগে অভিযান চালাচ্ছে। শতাধিক গাড়ি আটকও হয়েছে।” জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, অবৈধ ভাবে বালি চুরি হলে মাইনস এন্ড মিনারেলস অ্যাক্টে মামলা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিকের স্বীকারোক্তি, “চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু চুরি বন্ধ করতে পারিনি।”

প্রশাসন সূত্রের খবর, আগে নদীগুলি থেকে যথেচ্ছ ভাবে বালি তোলা হচ্ছিল। সম্প্রতি ন্যশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল খাদানগুলি থেকে নতুন কিছু নিয়ম বলবৎ করে খাদান থেকে বালি তোলার নির্দেশ দিয়েছে। এর পরই পশ্চিম মেদিনীপুরে নতুন করে অনুমতি দেওয়ার কাজ শুরুও করেছে। কিন্তু তাতে রোখা যায়নি অবৈধ বালি পাচার। অভিযোগ, যাঁরা কোটি কোটি টাকা জমা দিয়ে বালি তোলার অনুমতি পাচ্ছেন, তাঁরাও আবার ঘুরপথে বালি ‘চুরি’ করছেন। একটি অনুমতি দেখিয়ে একাধিক বার খাদান থেকে বালি তুলে পাচার হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, গড়বেতা, গোয়ালতোড়-সহ বিভিন্ন বালি খাদানে মাস কয়েক আগেই অনুমতি দেওয়া শুরু হয়েছে। ওই অনুমতিপত্রে মৌজার নাম উল্লেখ থাকে। পাশাপাশি কত পরিমাণ বালি তুলতে পারবেন, তাও পরিষ্কার ভাবে লেখা থাকে। নির্দিষ্ট সময়ের পর পুনর্নবীকরণ করতে হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement