হালদারদিঘিতে অভিষেক (বাঁ দিকে)। নিজস্ব চিত্র ও কৌশিক সাঁতরা
চায়ে পে চর্চায় এ বার অভিষেকও।
ঘাটালের ক্ষীরপাই শহরের হালদারদিঘির মোড়ে রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় জমল চায়ের আড্ডা। তবে অন্য দিনের চেয়ে এ দিনটা আলাদা। আড্ডাবাজের ভূমিকায় যে হাজির স্বয়ং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই শুনলেন মানুষের অভাব, অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চালু করেছিলেন ‘চায়ে পে চর্চা’। তা নিয়ে কটাক্ষও করেছিল তৃণমূল। বিজেপি সাংসদ দিলীপ ঘোষ এখনও নিয়ম করে সকালে সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে নিয়ে চা খান। চা খেতে খেতে তুফানও তোলেন (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক এবং তৃণমূল সরকার প্রসঙ্গে হাতে গরম মন্তব্য করেন)। ‘নব জোয়ার’ কর্মসূচিতে বেরিয়ে এতদিন সে ভাবে চা খেতে খেতে জনসংযোগ সারতে দেখা যায়নি অভিষেককে। তবে এ দিনের চায়ের আড্ডায় অভিষেক ছিলেন মনোযোগী শ্রোতা।
এ দিন রবিবার শালবনিতে দলের পর্যালোচনা বৈঠক ছিল। সেখানে দলের নেতাদের পারফরম্যান্স নিয়ে কাঁটাছেড়া হয়। বিশেষ বিশেষ জায়গায় কোন্দল মেটানোর বার্তা দেন। শালবনি থেকে অভিষেকের পরের গন্তব্য ছিল চন্দ্রকোনা রোড। সেখানে রোড শোয়ে অংশ নেন তিনি। পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী রোড শোরের নির্দিষ্ট সময় থেকে দেড় ঘন্টা পর বিকেল ৪ টার পর শালবনি থেকে চন্দ্রকোনা রোডে পৌঁছন অভিষেক। তার অনেক আগের থেকেই চৌরাস্তার মোড় সহ মেদিনীপুরগামী রাস্তার দু'পাশে প্রচুর তৃণমূল কর্মী সমর্থক ভিড় জমান। গড়বেতা ১ ব্লক থেকেই ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক গাড়ি ভাড়া করে কর্মী সমর্থকেরা এসে চড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। গোয়ালতোড় ও চন্দ্রকোনা রোডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও আসেন অভিষেকের রোড শো প্রত্যক্ষ করতে। চন্দ্রকোনা রোডে চৌরাস্তার মোড়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুটা হেঁটে, কিছুটা গাড়ির উপরে উঠে, বসে কর্মীদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে সামনে থেকে দেখে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন তৃণমূলের কর্মী সমর্থকেরা। প্রায় এক কিলোমিটার পথে রোড শো করার পর কেশপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান তিনি। তাঁকে স্বাগত জানাতে চন্দ্রকোনা রোডে উপস্থিত ছিলেন অজিত মাইতি, সুজয় হাজরা, শ্রীকান্ত মাহাতো, দীনেন রায়, উত্তরা সিংহ সহ জেলা তৃণমূলের অনেক নেতা- নেত্রীই। ঢাকের বাদ্যির সাথে, ধামসা মাদলের তালে আদিবাসী রমনীদের নাচ ছিল অভিষেকের যাত্রাপথে। রোড শোতে হাত নাড়লেও, অভিষেক কিছু না বলায় হতাশ অনেক কর্মী সমর্থকই। চন্দ্রকোনা রোডে অভিষেকের রোড শোতে দীর্ঘক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থাকায় অসুস্থ হয়ে রাস্তাতেই বসে পড়েন গড়বেতা ৩ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি প্রবীণ নেতা নিমাইরতন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মাথায়, মুখে চোখে জল দিয়ে সুশ্রুষা করেন দলের কর্মীরা। পরে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
চন্দ্রকোনা রোড থেকে কেশপুরের মোহবনিতে ক্ষুদিরামের জন্মস্থানে আসেন অভিষেক। ক্ষুদিরামের মূর্তিতে মালা দেন তিনি। কথা বলেন ক্ষুদিরামে উত্তরসূরিদের সঙ্গে। সেখানে সাংবাদিক বৈঠকে নানা বিষয় নিয়ে সরব হন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। একশো দিনের কাজ প্রসঙ্গে অভিষেক বলেন, ‘‘১৫১টি কেন্দ্রীয় দল পাঠিয়েছেন। তারপরেও কেন আপনি বাংলার টাকা ছাড়ছেন না? একশো দিনের কাজের টাকা বন্ধ রেখেছেন। করুন না সিবিআই তদন্ত। কেউ তো বারণ করছে না। একশো দিনে যারা অভিযুক্ত তাদেরকে জেলে ঢোকান। যদি ২০ জন অভিযুক্ত থাকে, তার জন্য তো ২ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না।’’ রাজনীতির কারবারিদের একাংশের বক্তব্য, একশো দিনের কাজে টাকা আটকে রাখা নিয়ে এর আগে একাধিকবার সরব হয়েছেন অভিষেক। এমনকিস সিবিআই, ইডি-সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সি ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা করেছেন বারবারে। কিন্তু এ দিন যে ভাবে তিনি একশো দিনের কাজে সিবিআই তদন্তের প্রসঙ্গ তুললেন তা ইঙ্গিতপূর্ণ বলেই মানছেন রাজনীতির কারবারিরা।
কেশপুর থেকে অভিষেক গিয়েছিলেন চন্দ্রকোনা টাউনে। কালিকাপুরে শিবমন্দিরে প্রণাম করে শুরু হয় রোড শো। প্রায় ২ কিলোমিটারের সেই রোড শো শেষ হয় বাঁকাতে। হুডখোলা গাড়িতে হাত নাড়তে দেখা গিয়েছে অভিষেককে। বাঁকায় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ফের গাড়িতে ওঠেন। পৌঁছন ক্ষীরপাই শহরে। সেখানে চায়ের আড্ডা সেরে বীরসিংহে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি মাল্যদান করে স্মৃতিমন্দিরে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটান অভিষেক। বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখেন। প্রায় ২০ মিনিট স্মৃতিমন্দিরে ছিলেন তিনি। সেখান থেকে জনসংযোগ সারতে সারতে ঘাটাল স্টেডিয়াম।
মেদিনীপুরে এলেই বিদ্যাসাগর, ক্ষুদিরামকে ছুঁয়ে যান মমতা। জনসংযোগে দোকানে ঢুকে নিজের হাতে চা করা কিংবা চপ ভাজা— এ সবই তাঁর অনন্য কৌশল। নবজোয়ারেও অভিষেক বীরসিংহ, মোহবনির মাটিকে প্রমাণ জানালেন। চায়ে পে চর্চা নয়। ফেরালেন চায়ের আড্ডা।
(তথ্য সহায়তা: অভিজিৎ চক্রবর্তী, রুপশঙ্কর ভট্টাচার্য ও বরুণ দে)