ধৃত অরিন্দম চক্রবর্তী কান্নায় ভেঙে পড়লেন ঝাড়গ্রাম আদালত চত্বরে। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
হতে পারত আর একটা ‘কোশিশ’-এর গল্প। যেখানে স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেই মূক ও বধির। সত্তরের দশকে গুলজ়ার পরিচালিত ওই ছবিতে আরতি আর হরির সন্তান কথা বলতে পারবে কি না সেই উদ্বেগ ছিল। বাস্তবে মূক ও বধির দম্পতি অদিতি ও অরিন্দম চক্রবর্তীর ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। অদিতির গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট, খুনের চেষ্টা ও বধূ নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেফতার হলেন বছর বত্রিশের অরিন্দম।
শনিবার বিকেলে কলকাতার বাঘাযতীনের একটি মল থেকে অরিন্দমকে গ্রেফতার করল ঝাড়গ্রাম জেলার সাঁকরাইল থানার পুলিশ। অরিন্দম ওই মলেরই কর্মী। ধৃতকে রবিবার ঝাড়গ্রাম সিজেএম আদালতে তোলা হলে ১৪ দিন জেল হাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। এ দিন আদালত চত্বর থেকে সংশোধনাগারে যাওয়ার সময়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন অরিন্দম। গত জুনে অরিন্দমের বিরুদ্ধে সাঁকরাইল থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন অদিতির বাবা কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী। অভিযোগের ভিত্তিতে গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট, খুনের চেষ্টা ও বধূ নির্যাতনের ধারায় অরিন্দম-সহ চার অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল পুলিশ। কিন্তু হাওড়ার বেলুড়ের যে ঠিকানায় অরিন্দম থাকতেন সেখানে হানা দিয়ে এতদিন তাঁর সন্ধান মেলেনি। বাকি তিন অভিযুক্ত অরিন্দমের বাবা, মা ও ভাই আগেই হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেয়েছেন। তবে স্ত্রীর গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট করার অভিযোগ থাকায় অরিন্দমের আগাম জামিনের আর্জি খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট। সম্প্রতি অরিন্দম কোথায় রয়েছেন সেই তথ্য পুলিশ জানতে পারে। তাঁর নতুন মোবাইল ফোনের নম্বর জোগাড় করে পুলিশ। মোবাইল ফোনের লোকেশন খতিয়ে দেখে এবং অরিন্দমকে অনুসরণ করে পুলিশ নিশ্চিত হয় বাঘাযতীনের মলের স্টোরে তিনি কাজ করেন। এরপরই শনিবার সাঁকরাইল থানার ওসি খোন্দকার সাইফুদ্দিন আহমেদ, মামলার তদন্তকারী অফিসার এসআই সুব্রত প্রামাণিক এবং একজন এএসআই সজল সুর সাদা পোশাকে ওই মলে হানা দিয়ে অরিন্দমকে পাকড়াও করেন।
বছর তিনেক আগে ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইলের তুঙ্গাধুয়া এলাকার বাসিন্দা মূক ও বধির অদিতির সঙ্গে হাওড়ার বাসিন্দা অরিন্দমের পরিচয় হয়েছিল ফেসবুকের মাধ্যমে। অরিন্দমও মূক ও বধির। অদিতির বাবা কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী ওই কারখানার মন্দিরের পূজারী। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাঁকরাইল থানার কালী মন্দিরে সামাজিক ভাবে অদিতি-অরিন্দমের বিয়ে হয়। স্ত্রীকে নিয়ে বেলুড়ের ভাড়া বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যান অরিন্দম। প্রথম ছ’মাস সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও পণের দাবিতে অদিতির উপর শ্বশুরবাড়ির লোকজন অত্যাচার শুরু করে বলে অভিযোগ। অশান্তির জেরে অদিতির পেটে লাথি মারায় তাঁর গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যায় বলে অভিযোগ। তা সত্ত্বেও অদিতি স্বামীর ঘরে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এরপর অদিতিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হয়। অরিন্দম বেলুড়েই মাসির বাড়িতে অদিতিকে নিয়ে ওঠেন। কিন্তু অশান্তি পিছু ছাড়েনি। গত বছর কৃষ্ণেন্দু দাশনগরে ভাড়া বাড়িতে মেয়ে-জামাইকে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে অদিতিকে ফেলে বাবা-মায়ের কাছে চলে যান অরিন্দম। কৃষ্ণেন্দু মেয়েকে তুঙ্গাধুয়ার বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু অরিন্দমের খোঁজ মেলেনি। হাওড়ার নিশ্চিন্দা থানায় অভিযোগ করা হলেও মামলা রুজু হয়নি। শেষ পর্যন্ত গত ২৫ জুন ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন কৃষ্ণেন্দু।
ওই সময় বেলুড়ের বাড়িতে হানা দিয়ে অরিন্দম বা তাঁর পরিবারের কাউকেই পায়নি পুলিশ। অরিন্দমের পরিবার ঠিকানা বদল করেছিল। ইতিমধ্যে অরিন্দমের বাবা রবিন চক্রবর্তী, মা অর্পিতা ও ভাই অনির্বাণের আগাম জামিন মঞ্জুর করে হাইকোর্ট। অদিতির পরিবার অদিতিকে জোর করে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছে বলে ২১ অক্টোবর হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাসে মামলা করেন অরিন্দম। ইতিমধ্যে ঝাড়গ্রাম আদালতে বিশেষ ইন্টারপ্রেটারের সাহায্য নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অদিতির গোপন জবানবন্দি নথিভুক্ত করায় পুলিশ। হাইকোর্টের নির্দেশে হেবিয়াস কর্পাসের মামলায় অদিতি গত ২৮ অক্টোবর হাজিরা দেন। সব দিক খতিয়ে দেখে বিচারপতি হেবিয়াস কর্পাসের মামলাটি খারিজ করে দেন। এরপরই হাইকোর্টের মামলার নথি থেকে অরিন্দমের বর্তমান ঠিকানা জোগাড় করে পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিনহা বলেন, ‘‘অভিযুক্তের সন্ধান মিলতেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত করে দ্রুত চার্জশিট জমা দেওয়া হবে।’’