শুধু নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নেবেন না তাই নয়, মানসিক হাসপাতাল থেকে যাতে পরিজনকে ছাড়া না হয়, সে জন্য দলবল জুটিয়ে হামলা করার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে রাজ্যে। নতুন মানসিক স্বাস্থ্য আইন চালু হওয়ার পরে কলকাতা, বহরমপুর, পুরুলিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি মানসিক হাসপাতালে এই ঘটনা ঘটেছে।
দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষদের বাড়ি ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হতেই হামলার ঘটনা ঘটছে হাসপাতালে। কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক-নার্সদের কটুক্তিই শুধু নয়, মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদেরও গালিগালাজ, এমনকি মারধরের অভিযোগও উঠছে। অভিযোগ দায়ের হয়েছে পুলিশে। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের কথায়, ‘‘বিষয়টি উদ্বেগজনক। এই প্রবণতা রোধ করা সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জও।’’ এই প্রবণতা নতুন এক সামাজিক সমস্যারও ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
মানসিক হাসপাতালে ভর্তির পরে বহু সময়ে নিকটতম আত্মীয়কেও ফিরিয়ে নেয় না পরিবার। বছরের পর বছর হাসপাতালে কাটিয়ে সেখানেই মারা যান অনেকে। গত জুলাইয়ে চালু হওয়া মানসিক স্বাস্থ্য আইনে সুস্থ হওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজেই সই করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে পারার অধিকার দেওয়া হয়েছে। আইনে রাজ্যগুলিকে ‘মেন্টাল হেলথ রিভিউ বোর্ড’ তৈরি করতে বলা হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পরে পরিজনেরা ফিরিয়ে নিতে না এলে তিনিই বোর্ডের কাছে আবেদন জানাতে পারবেন। বোর্ডের সদস্যরা যদি মনে করেন, তিনি সুস্থ এবং তাঁকে ছেড়ে দেওয়া যায়, তা হলে তাঁদের শংসাপত্র নিয়ে সেই ব্যক্তি নিজেই হাসপাতাল থেকে বেরোতে পারবেন।
বিভিন্ন হাসপাতালে যাঁরা দীর্ঘদিন ভর্তি রয়েছেন, তাঁদের অনেকের বাড়িতেই সম্প্রতি শুরু হয়েছে ‘হোম ভিজিট’। সরকারি অনুমতি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা বাড়ি গিয়ে সুস্থ হওয়া মানুষকে নিয়ে আসার কথা বোঝাচ্ছেন। এও জানাচ্ছেন, তাঁরা না ফেরালে সেই ব্যক্তি নিজেই বাড়ি ফেরার আইনি অধিকার পেয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার পুরুলিয়া মানসিক হাসপাতালে গত ন’বছর ভর্তি থাকা এক যুবকের বাড়িতে গিয়েছিলেন হাসপাতালের কর্মীরা। অভিযোগ, ওই ব্যক্তির দাদা, বৌদি এবং তাঁদের মেয়ে দুর্ব্যবহার করে তাঁদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। তারপর শুক্রবার দলবল নিয়ে হাসপাতালে এসে তাঁদের ধাক্কাধাক্কি করে শাসানোও হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী শুক্লা দাস বড়ুয়া বলেন, ‘‘ওঁরা আপত্তিকর কথা বলছিলেন। ভিডিয়োয় আমাদের ছবিও তুলছিলেন। এমন ঘটনার মুখোমুখি আগে হইনি।’’ পুরুলিয়া মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসক ধীমান মণ্ডল বলেন, ‘‘বার বার ওই রোগীর বাড়িতে আমরা খবর পাঠিয়েছি। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছি। ওঁরা শোনেননি। কিন্তু শুক্রবার যা ঘটল, সেটা আগে কখনও কারও ক্ষেত্রে দেখিনি। তখন আমার আউটডোর চলছিল। বিষয়টি শুনে ঘটনাস্থলে পৌঁছই।’’
কেন ওঁরা এমন করলেন? সংশ্লিষ্ট পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা সরাসরি বলেন, ‘‘পাগলকে বাড়িতে রাখার কত ঝক্কি, সেটা যারা ভুক্তভোগী তারাই বোঝে।’’ মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায়ের মতে, ‘‘মনোরোগীদের প্রতি সমাজের মনোভাব সনাতন পরিবারের ধারণাকেও নানা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এটা যেভাবে হোক রুখতেই হবে।’’
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এমন একাধিক ঘটনার খবর এসেছে যেখানে পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্যই সুস্থ মানুষকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম অবশ্য বলেছেন, ‘‘মানসিক হাসপাতালে রোগীকে বরাবরের জন্য ফেলে যাওয়ার উদ্দেশ্যই থাকে অনেকের। এর মূল কারণ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার মনোভাব। নতুন আইনের কথা যতদিন না সাধারণ মানুষ আরও বেশি করে জানতে পারবেন, ততদিন এটা আটকানো মুশকিল। প্রশাসনকেই কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।’’
এর আগে এক মহিলার তিন ভাই ও দুই বোন জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা ওই মহিলাকে নিজেদের বোন বলে স্বীকার করেন না। পারিবারিক সম্পত্তিও নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলেন ওঁরা। আরেকটি ক্ষেত্রে মানসিক হাসপাতালে ১৫ বছর আগে রেখে যাওয়া এক ব্যক্তির স্ত্রী এবং প্রতিষ্ঠিত সন্তানেরাই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের সামাজিক সম্মান নষ্ট হবে। ফলে ওই ব্যক্তিকে তাঁরা বাড়িতে নেবেন না।