n নবদ্বীপে প্রণব মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র
মহারানি বাগে তাঁর বাংলোয় গিয়ে খানিকটা বেকুব হয়ে গিয়েছিল সুদূর নবদ্বীপ থেকে যাওয়া যুবকটি। দক্ষিণ দিল্লির অভিজাত অঞ্চলে দেশের তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর বাড়ি শুনশান!
সেটা ছিল এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ। দিল্লির প্রবল গরম এড়াতে একটু সকালেই বেরনো। তাই বলে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি এত ফাঁকা! তা হলে? সে দিন বিব্রত শুভাশিস কংসবণিককে তাঁর ঠিক ঠিকানার হদিস দিয়েছিলেন বাংলোর কেয়ারটেকার। বলেছিলেন—‘‘এখানে নয়, স্যরকে পাবেন তালকটোরা রোডের বাড়িতে।’’
সেটা ছিল ১৯৯৭ সাল। নরসিংহ রাও মন্ত্রীসভার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় অন্য একটি কাজে নবদ্বীপে আসবেন জানতে পেরে শহরের এক অভিজাত ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাঁদের নতুন ভবন উদ্বোধন করার জন্য আমন্ত্রণ করতে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ ক্লাবের সদস্য শুভাশিস।
“সেখানে গিয়ে আর এক চমক। নানা প্রোটোকল পেরিয়ে তাঁর বসার ঘরে গিয়ে দেখি, আরও কয়েক জন অপেক্ষা করছেন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই তিনি এলেন। একটা চেক লুঙ্গি, সাদা শার্ট। কাঁধে একটা তোয়ালে ফেলা। দেখে অবাকই হয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে, এত সাদামাটা ভাবে দেখতে প্রস্তুত ছিলাম না। নবদ্বীপ থেকে এসেছি শুনেই বলে উঠলেন, ‘বলো কী, মহাপ্রভুর দেশ থেকে এসেছ!’ যেন খুশিতে ভরে উঠলেন। মিনিট আটেক ধরে নবদ্বীপের নানা গল্প করলেন। তার পর না খাইয়ে ছাড়বেন না। কেক, কাজু, সন্দেশ খেয়ে তবে আসার অনুমতি পেয়েছিলাম। উনি সম্মতি দিয়েছিলেন যে আসবেন।”— এ দিন বলছিলেন শুভাশিস।
কথা রেখেছিলেন প্রণব। কয়েক সপ্তাহ পর ১৮ মে, নবদ্বীপে এসে অন্য কর্মসূচির ফাঁকে গিয়ে নারকেল ফাটিয়ে, ফিতে কেটে উদ্বোধন করেছিলেন ক্লাবের নতুন দ্বিতল ভবন। সে দিনের স্মৃতি হাতড়ে শুভাশিস বলেন, “আমাদের ক্লাব বরাবরই জাতীয়তাবাদী। সব দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। একটু সন্দেশ আর ডাবের জল ছাড়া কিছুই খাননি। বলেছিলেন, নবদ্বীপের সন্দেশ ছাড়া যায় না।” নবদ্বীপের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক বিজনকুমার সাহার নিজের শোওয়ার ঘরের খাটটি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত। সে দিন দুপুরে কিছু ক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিয়েছিলেন ওই ঘরে।
একটা সময়ে রাজনৈতিক কারণে নবদ্বীপে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের যাতায়াত ছিল নিয়মিত। বাংলা কংগ্রেস, সমাজবাদী কংগ্রেস বা জাতীয় কংগ্রেস— তিনি যখন যে মঞ্চ থেকেই রাজনীতি করুন না কেন, নবদ্বীপের সঙ্গে তাঁর একটা যোগাযোগ ছিল। অথচ, নবদ্বীপে তাঁর কোনও বিরাট সংগঠন বা অনুগামী ছিলেন, এমনও নয়। তবু নানা সময়ে নবদ্বীপের মন্দির থেকে গ্রন্থাগার, ক্লাব থেকে রাজনৈতিক সভা তাঁকে বারে বারে পেয়েছে।
যেমন, ১৯৯৭ সালের ১৮ মে। নরসিংহ রাও মন্ত্রীসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি দেশের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় নবদ্বীপে এলেন। কিন্তু সে বার কোনও রাজনৈতিক কারণে নয়। নিখিল ভারত সাহিত্য সম্মেলনের গভর্নিং বডির মিটিং সে বার নবদ্বীপে হয়েছিল। সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি হিসাবে সে দিন নবদ্বীপে এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, নবদ্বীপে সেই আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা স্বপন আচার্য। তিনি বলেন, “প্রণববাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৪ সাল থেকে। তখন আমি সাইকেলে ভারত ভ্রমণ করছি। সে বছর দিল্লি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন। পর দিন যাত্রা শুরু আগে একশো টাকাও দেন। পরবর্তী কালেও সেই সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। নবদ্বীপ নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের কাজে এর পর বহু বার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে।”
সে বার তিনি সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন নবদ্বীপ সাধারণ গ্রন্থাগারে। সম্পাদক নিশীথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ নবদ্বীপ শহরের প্রাচীন গ্রন্থাগারে এসে তাঁর ভাললাগা তিনি বারে বারে বলেছেন। আমাদের ভিজিটর্স বুকেও লিখেছেন সে কথা। কাল থেকে ওঁর সঙ্গে তোলা ছবিটা খুঁজেই যাচ্ছি।”
চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের একটা বারান্দায় চুপ করে বসেছিলেন অদ্বৈত দাস বাবাজি। হাতে জপমালার বদলে সকালের খবরে কাগজ। মন্দির চত্বর থমথম করছে। নাটমন্দিরে বসেনি কীর্তনের আসর। খবরের কাগজের তলা থেকে মন্দির প্রধান বের করে আনেন এক খণ্ড জেরক্স করা কাগজ। সাদা এ-ফোর কাগজে পুরনো একটি পৃষ্ঠা থেকে কপি করা কয়েকটি লাইন বাংলায় লেখা— “মহাপ্রভুর পবিত্র জন্মভিটা প্রাঙ্গণে এসে আনন্দ পেলাম। মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম মানুষকে আজও উজ্জীবিত করে। মহাপ্রভুর চরণে প্রণাম।” লেখার নীচে সাক্ষর, প্রণব মুখার্জী, ১৮/০৫/ ৯৭।
তেইশ বছর আগের সেই দিনে ফিরে গিয়েছিলেন নবদ্বীপের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস মহারাজ। একটি ঘর দেখিয়ে বলেন, “তখন ওই ঘরটা ছিল মন্দিরের অফিস ঘর। বিকেল নাগাদ এসেছিলেন। ঘুরে ঘুরে সব দেখে অফিস ঘরে অনেক ক্ষণ বসে কথা বলেন। এক বারও মনে হয়নি, অত বড় মাপের এক জন অর্থনীতিবিদ এবং দেশের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছি।”