বনগাঁ শাখার বামনগাছিতে মহিলাদের উপর চড়াও পুরুষ যাত্রী। —নিজস্ব চিত্র।
নারী-পুরুষের অধিকারবোধ নিয়ে বিরোধ বাদানুবাদের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল ইট ছোড়াছুড়ি ও মারধরে। ট্রেন তথা কামরা সংরক্ষণের দাবি-পাল্টা দাবিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া ওই সংঘাত বুধবার অবাধ নৈরাজ্যের চেহারা নেয়। তারই সুযোগ নিয়ে মহিলাদের গয়না ও জিনিসপত্র লুঠ করার পাশাপাশি ব্যাপক যৌন হেনস্থারও অভিযোগ উঠেছে। ট্রেনের কামরায় আক্রান্ত হয়ে রীতিমতো মৃত্যুভয় তাড়া করেছে মহিলা যাত্রীদের। গণ্ডগোলে পুলিশ-যাত্রী মিলিয়ে সাত জন জখম হয়েছেন।
বিক্ষোভ যে বিপদসীমা ছাড়াচ্ছে, তার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল সোমবারই। মাতৃভূমিতে পুরুষ যাত্রীদের ওঠাকে কেন্দ্র করে সে দিন ধুন্ধুমার বেধেছিল খড়দহ স্টেশনে। কিন্তু সেই ঘটনা থেকে যে কোনও শিক্ষাই নেননি রেলকর্তারা, বুধবারের ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। খোদ রেলকর্তাদেরই একাংশের মতে, মাতৃভূমি নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে পূর্ব রেল যে সব নির্দেশ দিয়েছে, তা যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। এর সুযোগ নিয়েই এ দিন দফায় দফায় বামনগাছি, দত্তপুকুর, বিরাটি, অশোকনগর, হৃদয়পুর, মধ্যমগ্রাম স্টেশনের কোথাও অবরোধ, কোথাও পাল্টা অবরোধ, কোথাও খণ্ডযুদ্ধ বেধেছে। গোটা ঘটনায় এক দিকে রেল, রেলরক্ষী বাহিনী ও রেল পুলিশের অদূরদর্শিতা এবং সিদ্ধান্তহীনতাই প্রকট হয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের বড় অংশের অভিযোগ। অন্য দিকে কয়েকটি জায়গার তাণ্ডবে যে
রকম পূর্ব পরিকল্পনা ও সংগঠিত পদ্ধতির ছাপ মিলেছে, তাতে বিশেষ কোনও ইন্ধন আছে কি না, সেই সন্দেহও দানা বেঁধেছে।
বিরোধের সূত্রপাত, মহিলাদের ট্রেন মাতৃভূমি লোকালের কয়েকটি কামরায় পুরুষদের ওঠার অনুমতিকে ঘিরে। ২০১০ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিয়ালদহ ও হাওড়া শাখায় বিশেষ মহিলা ট্রেন চালু করেছিলেন। নাম দেওয়া হয়েছিল মাতৃভূমি লোকাল। নিত্যযাত্রীদের মুখে এই ট্রেন ‘লেডিজ স্পেশ্যাল’ বলেই পরিচিত। দু’বছর পরে হাওড়া-খড়্গপুর শাখায় মাতৃভূমির মাঝখানের তিনটি কামরায় পুরুষ যাত্রীদের ওঠার অনুমতি দেয় রেল। গত বছর শিয়ালদহ দক্ষিণেও ওই একই নিয়ম চালু হয়। ফলে হাওড়া-শিয়ালদহ মিলিয়ে মোট আটটি মাতৃভূমি লোকালের মধ্যে চারটিতে পুরুষ যাত্রী ওঠার অনুমতি মেলে। বাকি ছিল শিয়ালদহ মেন ও বনগাঁ লাইনের চারটি মাতৃভূমি ট্রেন।
স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন, গত শনিবার ওই চারটি ট্রেনেও পুরুষদের ওঠার অনুমতি দেয় পূর্ব রেল। তাই পরেই সোমবার রানাঘাট-শিয়ালদহ মাতৃভূমি লোকাল আটকে খড়দহে বিক্ষোভ শুরু করেন মহিলা যাত্রীরা। সে দিন লাঠি চালিয়ে-কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল পুলিশ। পরে সেই রাতেই রেল জানায়, শিয়ালদহ মেন ও বনগাঁ লাইনে মাতৃভূমি লোকালের কয়েকটি কামরায় পুরুষদের উঠতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হচ্ছে।
সকালের বনগাঁ মাতৃভূমি লোকাল তখন বিরাটিতে।
ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন মেয়েরা। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।
কিন্তু সোমবার রাতের সেই ঘোষণা মঙ্গলবারই আংশিক বদলে যায়! রেলকর্তারা জানান, শিয়ালদহ ও রানাঘাটের মধ্যে যে এক জোড়া ‘লেডিজ স্পেশ্যাল’ চলাচল করে, সেটি ছাড়া বাকি তিনটি মাতৃভূমি লোকালের কিছু কামরায় পুরুষরা উঠতে পারবেন। বুধবার সকালে এই খবর চাউর হতেই শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখার বিভিন্ন স্টেশনে শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ। এক দিকে মহিলারা, অন্য দিকে পুরুষরা। হোয়াটসঅ্যাপ-এসএমএস-ফেসবুকের দৌলতে নানা রকম গুজব উল্কার গতিতে ছড়াতে থাকে এক তল্লাট থেকে অন্য তল্লাটে, প্রভাবিত করতে থাকে যাত্রীদের। বিশেষ করে মহিলা যাত্রীরা চলন্ত ট্রেন থেকে এক পুরুষ যাত্রীকে ঠেলে ফেলে দিয়েছেন বলে রটে যাওয়ায় অশান্তি আরও বাড়ে। বিপন্ন বহু যাত্রীর অভিযোগ, ১০০ ডায়ালে ফোন করে, থানায় জানিয়ে লাভ হয়নি।
এ দিন সকাল সওয়া আটটা নাগাদ বনগাঁ থেকে বামনগাছি স্টেশনে ঢোকে মাতৃভূমি লোকাল। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ছ’টি কামরার কোথাও কোথাও কয়েক জন পুরুষযাত্রী জোর করে উঠে অশালীন ব্যবহার করেছেন— এই অভিযোগ তুলে লাইনে বসে অবরোধ শুরু করেন মহিলারা। অবরোধে সামিল শম্পা চক্রবর্তী লাহিড়ী বলেন, ‘‘আমাদের দাবি নিয়ে সোমবার শিয়ালদহের ডিআরএম অফিসে লিখিত আবেদন করেছি। দু’দিন ধরে আমাদের নির্ধারিত কামরায় পুরুষযাত্রীরা উঠে অসভ্য আচরণ করছেন।’’ সেই সময়ে পুরুষ যাত্রীরা একে একে জড়ো হচ্ছিলেন প্ল্যাটফর্মে। তাঁদের দিক থেকে অবরোধকারী মহিলাদের উদ্দেশে চলতে থাকে কটূক্তি ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি। প্রথমে লাইনের উপরেই দু’পক্ষের বচসা শুরু হয়। সেটা গড়ায় ধাক্কাধাক্কি পর্যন্ত। অবরোধকারীদের লক্ষ্য করে শুরু হয় পাথরবৃষ্টিও। কল্যাণী দত্ত নামে এক যাত্রীর মাথায় পাথর লাগে। তাঁকে বারাসত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বারাসত জিআরপি থানায় তিনি লিখিত অভিযোগও করেন। অলি মিস্ত্রি নামে আর এক নিত্যযাত্রীর দাবি, তাঁকে বেধড়ক মারধর করেন এক পুরুষ যাত্রী।
এই খণ্ডযুদ্ধের মধ্যে মহিলা যাত্রীরা জিআরপিকে ফোন করেন। কিন্তু তাঁদের অভিযোগ, দেড় ঘণ্টা পর পুলিশ পৌঁছয়। জিআরপি নয়, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের একটি দল। আবার বামনগাছির এক পুরুষ যাত্রীর অভিযোগ, তিনি মহিলা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁর গালে এক জন থাপ্পড় মারেন। তিনি এক কনস্টেবলের কাছে অভিযোগ জানাতে যান। কিন্তু সেই পুলিশ অভিযোগে আমল না দিয়ে তাঁকে সরে যেতে বলেন। ফলে বহু পুরুষ যাত্রী ওই কনস্টেবলের উপর ক্ষুব্ধ হন।
শেষে দত্তপুকুর থানার ওসি বিশ্বজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় ওই কনস্টেবলের গালে চড় মেরে তাঁকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানোর পর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
বামনগাছির অবরোধের জেরে তত ক্ষণে প্রায় সমস্ত স্টেশনেই ট্রেন আটকে পড়েছে। বিড়া স্টেশনে সকাল আটটা আট মিনিটের বনগাঁ লোকালের এক কামরায় এক পুরুষ যাত্রী ফোন করে কাউকে একটা নির্দেশ দিলেন, ‘‘ওদের মেরে উঠিয়ে দে।’’ তার পর গজগজ করে বলতে শুরু করলেন, ‘‘মাতৃভূমি লোকাল বন্ধ করে ওটাকে পিতৃভূমি বানাতে হবে!’’ অন্য এক বয়স্ক যাত্রী চিত্কার করে সহযাত্রীদের উদ্দেশে বলতে শুরু করলেন, ‘‘এই কামরায় যে সমস্ত মহিলা যাত্রী আছেন, দয়া করে তাঁরা নেমে যান। এটা পুরুষদের কামরা!’’ কোণের দিকে দু’জন মহিলা ছিলেন, নেমে গেলেন। এর পর দত্তপুকুর স্টেশনে অবরোধ করে পুরুষ যাত্রীরা দাবি জানাতে থাকেন, মাতৃভূমি বাতিল করে সর্বসাধারণের জন্য ট্রেন চালু করতে হবে। লাইনের উপর তুলে দেওয়া হয় স্লিপার। পাথর জড়ো করে রাখা হয়। ঘণ্টাখানেক পর র্যাফ এবং কমব্যাট ফোর্স নামলে অবরোধ ওঠে।
সকাল ৯টা নাগাদ শিয়ালদহমুখী আর একটি মাতৃভূমি লোকাল ছেড়েছিল বারাসত থেকে। অভিযোগ, ওই ট্রেনের পুরুষযাত্রীরাও মহিলাদের কামরায় উঠে পড়েন। শুরু থেকেই দু’পক্ষের বচসা চলছিল। এরই মধ্যে বিশরপাড়া-কোদালিয়া থেকে ফের এক দল যুবক জোর করে মহিলাদের কামরায় ওঠে। এর মধ্যে বিশরপাড়ার বাসিন্দা দীপঙ্কর দে নামে এক যুবক বিরাটিতে নামতে গিয়ে পড়ে যান। ওই যুবকের দাবি, তিনি তাড়াতাড়িতে না দেখেই মহিলা কামরায় উঠে পড়েছিলেন। তাঁকে ধাক্কা মেরে কামরা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মহিলা যাত্রীরা ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁদের দাবি, ধাক্কাধাক্কিতেই পড়ে যান দীপঙ্কর। পুলিশ সূত্রেও খবর, যুবকের পা ছড়ে গিয়েছে। চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গেলে যেমন চোট পাওয়ার কথা, তেমন প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু দ্রুত ছড়াতে থাকে গুজব। বিশরপাড়া আর অশোকনগরে অবরোধ শুরু হয়। আর, বিরাটি মাতৃভূমি লোকালে শুরু হয়ে যায় তাণ্ডব। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, এই হাঙ্গামায় নিত্যযাত্রীদের সঙ্গে যোগ দেন প্ল্যাটফর্মের হকার এবং স্থানীয় বাসিন্দারাও। একদল যুবক কামরায় উঠে গালিগালাজ করতে করতে মহিলাদের ট্রেন থেকে নামতে বলে। তরুণীদের ওড়না ধরে টানা হয়, গায়ে হাত দেওয়া হয়। মোবাইলে সেই ছবি তুলতে গেলে কয়েক জনের মোবাইলও কেড়ে নেওয়া হয়। প্রায় টানতে টানতে তাঁদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয় যুবকেরা। সেই খবর বামনগাছিতে পৌঁছলে মহিলা যাত্রীদের সঙ্গে পুরুষ যাত্রীদের আর এক প্রস্ত ধস্তাধস্তি, মারপিট শুরু হয়।
ঘটনাটা এত দূর গড়াল কেন? চার দিনে তিন বার সিদ্ধান্ত বদলই তার মূল কারণ বলে মেনে নিচ্ছেন রেলকর্তাদের একাংশ। তাঁদের কথায়, ‘‘যে ভাবে পরপর নির্দেশ পরিবর্তন করা হয়েছে তাতে যাত্রীরা বিভ্রান্ত হয়েছেন।’’ এক প্রবীণ রেলকর্তার কথায়, ‘‘কোনও কিছু খতিয়ে না দেখে মাতৃভূমি লোকাল চালু করা হয়েছিল। তার নিয়ম বদলের সময়েও খামখেয়ালিপনা করা হয়েছে।’’ টানা কয়েক দিন বিজ্ঞাপন দিয়ে যাত্রীদের প্রতিক্রিয়া দেখে নেওয়া উচিত ছিল। যাত্রীদের কমিটির সঙ্গেও কথা বলা দরকার ছিল। কিছুই করা হয়নি। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র অবশ্য বলছেন, ‘‘পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। খড়দহে গণ্ডগোলের পরে রানাঘাট মাতৃভূমি নিয়ে সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়। তখন তো বনগাঁ নিয়ে ঝামেলা হয়নি। এখন কেন হচ্ছে! রেল তার বিজ্ঞপ্তি থেকে সরছে না।’’
এমতাবস্থায় মহিলাদের দাবি, মাঝখানের ৩-৪টি কামরায় পুরুষদের উঠতে দিলে বাস্তবে গোটা ট্রেনটাই পুরুষদের দখলে চলে যাবে। যেমন এ দিন মহিলা কামরায় জোর করে পুরুষরা উঠেছিলেন বলে অভিযোগ। তার থেকেই এ দিনের গণ্ডগোলের সূত্রপাত। আর পুরুষদের দাবি, মাতৃভূমি ফাঁকা থাকলেও তাঁরা ওঠার সুযোগ পাবেন না, এটা ঠিক নয়। বছর কয়েক আগে মেট্রোতেও মহিলা কামরা চালু নিয়ে গোলমাল বেধেছিল। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই মেট্রো সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। এ বারের গোলমাল বাড়ার পিছনে রেল পুলিশের গাফিলতির কথা তুলেছেন অনেকে। যদিও জিআরপি কর্তারা বলছেন, একসঙ্গে একাধিক জায়গায় অবরোধ সামাল দেওয়ার মতো পুলিশ তাদের হাতে নেই। মহিলা বিক্ষোভকারীদের হঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় মহিলা পুলিশও নেই। পরিকাঠামোগত খামতির কারণেই অবরোধ তুলতে দেরি হয়েছে।