ভয় কাটেনি মেয়েদের

মাতৃভূমি মোড়া পুলিশে, পরে কী হবে সেটাই প্রশ্ন

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে গেরস্তের। আর মহিলাদের মারধর, তাণ্ডবের মধ্যে ফেলে, ইটের ঘায়ে নিজেদের মাথা ফাটিয়ে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধি খুলল পুলিশের। সোমবার গোলমালের আশঙ্কা থাকলেও পুলিশের গা-ছাড়া মনোভাবের জেরে মাতৃভূমি লোকালকে ঘিরে হাবরায় রক্তারক্তি কাণ্ড হয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩০
Share:

আতঙ্কের মাতৃভূমিতে যাত্রী কম। তবে মঙ্গলবার কামরায় মোতায়েন ছিল পুলিশ। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে গেরস্তের। আর মহিলাদের মারধর, তাণ্ডবের মধ্যে ফেলে, ইটের ঘায়ে নিজেদের মাথা ফাটিয়ে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধি খুলল পুলিশের।

Advertisement

সোমবার গোলমালের আশঙ্কা থাকলেও পুলিশের গা-ছাড়া মনোভাবের জেরে মাতৃভূমি লোকালকে ঘিরে হাবরায় রক্তারক্তি কাণ্ড হয়েছে। শুধু অবরোধ, ভাঙচুরই নয়। হামলাকারীরা ট্রেনে উঠে মারধর করেছে মহিলা যাত্রীদের। রীতিমতো তাড়া করে ভাগিয়েছে পুলিশকে। তাদের ইটের ঘায়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক পুলিশ-অফিসার। জখম আরও কয়েক জন।

এত কাণ্ডের পরে পুলিশের যে টনক নড়েছে, তা দেখা গেল মঙ্গলবার। এ দিন কড়া পুলিশি পাহারায় মাতৃভূমি লোকাল এল বনগাঁ থেকে শিয়ালদহে। আগ্নেয়াস্ত্র, কাঁদানে গ্যাস, ঢাল নিয়ে হেলমেট পরা পুলিশের বিশাল বাহিনী দেখে এ দিন আর মাতৃভূমি আটকানোর সাহস দেখায়নি ‘পিতৃভূমি লোকাল’-এর দাবিদাররা। তবে সহজে হাল ছাড়া যে হবে না, এ দিন মহিলাদের লক্ষ্য করে তাদের মন্তব্য থেকে তা অনেকটাই স্পষ্ট। মাতৃভূমিতে উঠতে না পারলেও বিভিন্ন স্টেশন থেকে থেকে চিৎকার করে তারা শুনিয়ে দিয়েছে, ‘‘কত দিন আর পুলিশ থাকবে! তার পর কে বাঁচাবে!’’

Advertisement

সোমবার বনগাঁ-শিয়ালদহ মাতৃভূমি লোকালে হামলার ঘটনার পরে এ দিনও সন্ত্রস্ত হয়েই ট্রেনে উঠেছিলেন মহিলা নিত্যযাত্রীরা। যাত্রীর সংখ্যা অন্য দিনের তুলনায় অনেকটাই কম ছিল। ট্রেনের একটি কামরায় উঠে দেখা গেল, নিত্যযাত্রীদের পাহারা দিচ্ছেন বারো জন আরপিএফ জওয়ান এবং রেল পুলিশ (জিআরপি)। এ ছাড়াও রয়েছেন জনা দশেক মহিলা পুলিশ। গোটা বগিতে তখন যাত্রী সাত জন।

একই চিত্র গোটা ট্রেনটিতেই। এ দিন কার্যত নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছিল মাতৃভূমি লোকালকে। পুলিশ জানিয়েছে, সকালেই বিভিন্ন এলাকা থেকে আরপিএফ জওয়ান ও জিআরপির বাহিনী নিয়ে আসা হয়েছিল বনগাঁ স্টেশনে। সঙ্গে ছিল জিআরপি-র সিভিক ভলান্টিয়াররাও। শুধু ট্রেনেই নয়, বনগাঁ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত প্রতিটি স্টেশনেই মোতায়েন ছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী। তবে এ দিন পুলিশকে কোনও ঝামেলায় পড়তে হয়নি। সেটা স্বস্তি দিয়েছে রেলপুলিশ কর্তাদের।

সোমবারের অভিজ্ঞতার পর মাতৃভূমির নিত্যযাত্রী মহিলাদের অনেকেই মঙ্গলবার ট্রেনে উঠতে সাহস পাচ্ছিলেন না। রানাঘাটের বাসিন্দা মেনকা বালা সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বনগাঁ প্ল্যাটফর্মে শিয়ালদহ মাতৃভূমির কাছে ঘোরাঘুরি করছিলেন। বলছিলেন, ‘‘ট্রেনে উঠতে সাহস পাচ্ছি না। যদি কালকের অবস্থা হয়!’’ শেষে প্রচুর পুলিশ দেখে তিনি ট্রেনে উঠে পড়েন। ট্রেনে চেপে অনেকেই বলেছেন, ‘‘ভগবানের ভরসাতেই ট্রেনে চেপেছি।’’ বনগাঁ ছেড়ে ৭টা ৪১ মিনিটে ট্রেনটি যেই মছলন্দপুর থেকে হাবরার দিকে রওনা হল, তখন কামরার মধ্যে যেন আলপিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। দূর থেকে হাবরা স্টেশন দেখা যেতেই উৎকণ্ঠায় অনেকেই একে অপরের হাত ধরে ফেলেন। ৭টা ৫০ মিনিটে ট্রেনটি হাবরা স্টেশন ছাড়তে স্বস্তি ফিরল।

কিন্তু ক’দিন এই পরিস্থিতি থাকবে? মহিলা যাত্রীরা জানালেন, বিভিন্ন স্টেশনে পুরুষযাত্রীদের একাংশ এ দিনও তাঁদের ফের হুমকি দিয়েছেন। মহিলাদের অভিযোগ, একটা স্টেশন থেকে আর একটা স্টেশনে ফোন করে কয়েক জন একে অপরকে ট্রেনের পরিস্থিতি কী, কেমন পুলিশ পাহারা রয়েছে ইত্যাদি তথ্য জানিয়ে দিচ্ছিলেন। মহিলাযাত্রীদের তাই আশঙ্কা, পুলিশ পাহারা শিথিল হলেই আবার তাণ্ডব চালাতে পারে হামলাকারীরা। গত কয়েক দিন ধরে যে সব মহিলারা পুরুষদের ট্রেনে ওঠার বিরোধিতা করেছিলেন, আতঙ্কে রয়েছেন তাঁরাও। শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার দেবাশিস বেজ অবশ্য এ দিন মহিলাযাত্রীদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘‘আপাতত মাতৃভূমি থেকে পুলিশ পাহারা সরানো হচ্ছে না।’’

তবে শুধু পুলিশ দিয়ে যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না,

তা আন্দাজ করেই বনগাঁ থেকে বারাসত পর্যন্ত বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে হাজির ছিলেন তৃণমূল নেতারাও। পুরুষ যাত্রীরা যাতে মাতৃভূমিতে না উঠে পড়েন, তা সামলাতে দেখা গিয়েছে তাঁদের। গোবরডাঙা স্টেশনে নাছোড় দু’জন পুরুষ যাত্রী আরপিএফ-পুলিশকে ঠেলেঠুলেই উঠতে যাচ্ছিলেন মাতৃভূমিতে। গোবরডাঙার তৃণমূল নেতা তথা কাউন্সিলর শঙ্কর দত্ত ওই দুই ব্যক্তিকে বুঝিয়ে নিরস্ত করেন। পরে শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘কোনও গোলমাল যাতে না বাধে, তাই আমরা মানুষকে বোঝাতে পথে নেমেছিলাম।’’ হাবরা স্টেশনে ঢোকার অনেক আগে থেকে এ দিন লোকজন নিয়ে হাজির ছিলেন হাবরা পুরসভার পুরপ্রধান নীলিমেশ দাস। বললেন, ‘‘দলীয় নির্দেশে আমরা এসেছিলাম।’’ জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও পরে বলেন, ‘‘আমরা দলীয় ভাবে মানুষকে বোঝাব, তাঁরা যেন মহিলা ট্রেনে না ওঠেন। এর পরেও যদি কেউ কথা না শোনেন, সেটা খুবই দুঃখজনক হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement