ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
তাপমাত্রা এখনও চল্লিশ ডিগ্রি ছোঁয়নি। অথচ মনে হচ্ছে তার বহুগুণ বেশি! সৌজন্য, বাতাসের অত্যধিক জোলো ভাব।
এই তুঙ্গ আর্দ্রতার দাপটেই বৃহস্পতিবার কলকাতা ও আশপাশে অস্বস্তির পারদ ৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেল। এবং প্রকৃতির যা হালচাল, তাতে আগামী ক’দিনে তা আরও চড়ার আশঙ্কা। সকালের মেঘলা আকাশ খানিক আশা জাগালেও বেলা বাড়তেই তা ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাচ্ছে। কেননা ততক্ষণে গনগন করে তাপ ছড়াতে শুরু করছে সূর্য। মাটি থেকে তাপ ঠিকরে বেরোচ্ছে। শরীর চাইছে ঘাম ঝরিয়ে নিজেকে ঠান্ডা রাখতে। মানুষ ঘামছেও কুলকুলিয়ে। কিন্তু সেই ঘাম শুকোতে পারছে না, উল্টে গায়ে জমে থাকছে। এক ফোঁটা হাওয়া নেই যে!
অতএব, ঘর্মাক্ত কলেবরে হাঁসফাঁস। জমা ঘামের চাপে শরীরের ভিতরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, হার্টবিট চড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের হারও। সব মিলিয়ে মাঝ মে’তে প্রবল অস্বস্তি মাথায় নিয়ে ধুঁকছে মহানগর। যার পিছনে আবহবিদেরা দেখছেন তিনটি কারণ। এক, মধ্য ভারত থেকে ধেয়ে আসছে গরম বাতাস। দুই, এখানে বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে ঘূর্ণাবর্ত। তিন, ঘূর্ণাবর্তের টানে সমুদ্র থেকে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে জলীয় বাষ্প।
এ হেন ত্র্যহস্পর্শের সুযোগে গরমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চেপে বসছে আর্দ্রতা। অসহ্য গুমোটে শরীর নেতিয়ে পড়ছে। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-বীরভূমে জলীয় বাষ্পের স্রোত পৌঁছতে না-পারায় অস্বস্তি কিছু কম হলেও সেখানে আবার লু’র দাপট! রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে আগামী দু’দিনের মধ্যে তাপপ্রবাহের পূর্বাভাসও দিয়ে রেখেছে হাওয়া অফিস।
মানে কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতন বা মুকুটমণিপুরে গিয়ে যে একটু নিস্তার মিলবে, তার জো নেই। ছেলের গ্রীষ্মের ছুটিতে কলকাতা বেড়াতে এসেছেন মুম্বইয়ের ব্যাঙ্ক অফিসার শুভেন্দ্র বাগচী। দু’দিনেই পালাই-পালাই। মুম্বই ফেরার টিকিটের জন্য বৃহস্পতিবার সকালে রেলের কাউন্টারে লাইন দিয়েছেন। বলছেন, ‘‘বেড়ানো মাথায় থাক। মুম্বইয়ে তা-ও এর চেয়ে ভাল।’’
পরিস্থিতির আশু উন্নতির সম্ভাবনা তো দূর, বরং অবনতিরই আশঙ্কা। আলিপুর আবহাওয়া অফিসের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ এ দিন জানিয়েছেন, প্রবল তাপপ্রবাহে জর্জরিত মধ্যপ্রদেশ থেকে গরম বাতাস বিহার-ঝাড়খণ্ড হয়ে দক্ষিণবঙ্গে ঢুকছে। ফলে এখানে তাপমাত্রা লাফিয়ে বাড়বে। বৃহস্পতিবার কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী দু’দিনে তা ৪০ ডিগ্রির কাছে উঠে যেতে পারে। তাপমাত্রা বাড়লেও জলীয় বাষ্পের রমরমা কিন্তু কমবে না। তাতেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন গোকুলবাবুরা।
বস্তুত আলিপুরের রেকর্ডেও সেই ইঙ্গিত। বছরের এই সময়টায় দুপুরবেলা কলকাতার বাতাসে জলীয় বাষ্পের ঘনত্ব থাকার কথা ৪০%। এ দিন ছিল ৫৬%। ৩৭.৬ ডিগ্রির তাপমাত্রার সঙ্গে দুঃসহ আর্দ্রতার যুগলবন্দিতে বেলা আড়াইটে নাগাদ কলকাতার অস্বস্তিসূচক গিয়ে দাঁড়ায় ৬৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা কি না
স্বাভাবিকের সাড়ে ১২ ডিগ্রি বেশি! গোকুলবাবুর হুঁশিয়ারি, আগামী দু’দিনে অস্বস্তিসূচক ৬৯ ডিগ্রিতেও পৌঁছে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, ২০১৩-য় মে’র শেষ সপ্তাহে কলকাতায় অস্বস্তিসূচক ৬৯ ডিগ্রির দোরগোড়ায় পৌঁছেছিল।
তার উপরে এ দিন দুর্ভোগে সঙ্গত করেছে শহরের নানা জায়গায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট, এমনকী হাসপাতালেও। মাথার উপরে ফ্যান ঘোরেনি, এসি স্তব্ধ। মানুষের কষ্ট ও বিরক্তি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। গত কয়েক দিনে তো দু’-এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে! তাতেও অস্বস্তি কমছে না কেন?
আমজনতার মনে প্রশ্নটা উঁকি-ঝুঁকি দিয়েছে। স্কুল-শিক্ষিকা বনানী দত্তের কথায়, ‘‘বৃষ্টি হলেও দেখছি, যে-কে সেই! বাড়িতে ছোটদের জ্বর, আমরা ধুঁকছি। ঠান্ডা জল খেলে, এসি চালালে গলা বসে যাচ্ছে। এমন কেন?’’
আবহবিদদের যুক্তি, বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তরের ঘূর্ণাবর্তের টানে জলীয় বাষ্প এসে বিক্ষিপ্ত ভাবে দু’-এক পশলা বৃষ্টি নামাতেই পারে। কিন্তু সার্বিক আবহাওয়া পরিস্থিতিকে বদলাতে পারে না। তা ছাড়া ঘূর্ণাবর্ত দুর্বল হয়ে গেলে অন্য বিপত্তি। ‘‘শুকনো গরমের চোটে তখন কলকাতাতেও তাপপ্রবাহ বইবে।’’— বলছেন গোকুলবাবু।
অর্থাৎ, কোনও দিকেই সুরাহা নেই। একমাত্র আশা বর্ষা। হাওয়া অফিস জানাচ্ছে, বর্ষা পুরোপুরি সক্রিয় হলে আবহাওয়া স্থিতিশীল হয়ে খানিক স্বস্তি মিলবে। তা বর্ষার হালচাল কী?
আবহাওয়া দফতরের উপগ্রহ-চিত্র দেখাচ্ছে, আন্দামানে এখন ভরপুর বর্ষা। নির্ধারিত ২০ মে’র দু’দিন আগেই সে ওখানে ঢুকে পড়েছে। তাতে অবশ্য বঙ্গবাসীর উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। কারণ, আন্দামান থেকে বর্ষা যাবে মায়ানমারে। তার পরে মিজোরাম দিয়ে ফের ভারতীয় ভূখণ্ডে। সেখান থেকে নামবে উত্তরবঙ্গে।
তাই ‘আন্দামানি পথে’ বর্ষা আসতে বহু দেরি। তার আগেই গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বর্ষা এসে পড়ে, কেরল রুট ধরে। নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, আরবসাগর হয়ে মৌসুমি বায়ুর ১ জুন কেরলে আসার কথা, ৮ জুন নাগাদ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে। মৌসম ভবনের পূর্বাভাস, এ মরসুমে কেরলে বর্ষা ঢুকে যাবে দু’দিন আগে। কিন্তু কলকাতাতেও দু’দিন আগে আসবে, তেমন গ্যারান্টি নেই। ‘‘কেরল থেকে বাংলায় পৌঁছাতে বর্ষা এক্সপ্রেসকে বহু বাধা পেরোতে হয়। লেট হতেই পারে।’’— মন্তব্য এক আবহবিদের। ওঁরা জানিয়েছেন, বর্ষা কী ভাবে এগোবে, সেটা নির্ভর করে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের উপরে। নিম্নচাপের ঘনঘটা যত বেশি হবে, তত বাড়বে বর্ষার গতি।
জ্বালা জুড়োতে অগত্যা নিম্নচাপের আশাই ভরসা।