অবশেষে ধরা দিলেন তিরিশ লাখি মাওবাদী

কুচকুচে কালো শার্ট-ট্রাউজার্স, মাথায় জংলা টুপি। পুলিশের সাঁটা পোস্টারে তাঁকে এই পোশাকেই দেখা গিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৫
Share:

সস্ত্রীক মাওবাদী নেতা। বুধবার ভবানী ভবনে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

কুচকুচে কালো শার্ট-ট্রাউজার্স, মাথায় জংলা টুপি। পুলিশের সাঁটা পোস্টারে তাঁকে এই পোশাকেই দেখা গিয়েছে।

Advertisement

বুধবার তখন বেলা ১টা ২৫। ভবানী ভবনের চার তলায় সিআইডি-র কনফারেন্স রুমের কোণের দরজাটা খুলে ওই পোশাকেই ঢুকলেন মাওবাদী নেতা রঞ্জিত পাল ওরফে রাহুল। হাতে একটি সেল্ফ লোডিং রাইফেল বা এসএলআর। সঙ্গে স্ত্রী ঝর্ণা গিরি ওরফে অনিতা। একই পোশাক তাঁরও। কনফারেন্স রুমে তখন রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের তাবড় কর্তারা। ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন মাওবাদী দম্পতি।

গত কয়েক বছর ধরে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় ও বান্দোয়ান এলাকা এবং ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা-গালুডিতে সক্রিয় ছিলেন এই মাওবাদী দম্পতি।

Advertisement

ধরা দেওয়ার পর দু’জনেই লিখিত বিবৃতি সংবাদমাধ্যমের সামনে গড় গড় করে পড়ে যান। যার মূল কথা— হিংসাত্মক আন্দোলনে জনগণ ও পরিবারের ভাল করা সম্ভব নয়, সেটা তাঁরা বুঝতে পেরেছেন। বরং, যে সব সমস্যার বিরুদ্ধে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার সেই সব সমস্যার সমাধান করেছে ও করছে। তাঁদের মতো যাঁরা ভুল পথে হেঁটেছেন, এই সরকার পুরনো অতীত ভুলে তাঁদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ দিচ্ছে। যাঁরা এখনও হিংসার পথে, তাঁদেরও এই ভাবে ধরা দিয়ে সমাজের মূলস্রোতে ফেরার আহ্বান জানান দম্পতি।

রঞ্জিত এটাও বলেন, ‘‘আমার সহিংস রাজনীতির জন্য যাঁদের ক্ষতি হয়েছে, যাঁরা মারা গিয়েছেন, আমি তাঁদের কাছে নতমস্তকে ক্ষমা চাইছি।’’

পুলিশ জানাচ্ছে, খুন-নাশকতার অন্তত ৫০টি মামলায় অভিযুক্ত রঞ্জিত। ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা মিলিয়ে তাঁর মাথার দাম প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা।

২০০৫-এর জুলাইয়ে বারিকুল থানার তদানীন্তন ওসি প্রবাল সেনগুপ্ত মাওবাদীদের বুবি ট্র্যাপে নিহত হন। একটি পরিত্যক্ত ব্যাগের চেন খোলামাত্র বিস্ফোরণ হয়। ওই ঘটনায় রঞ্জিতকে গ্রেফতার করা হলেও পরে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে গা-ঢাকা দেন। ফের তাঁর নাম সামনে আসে ২০০৭-এর মার্চে, পূর্ব সিংহভূম জেলার বাকুরিয়ায় ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সাংসদ সুনীলকুমার মাহাতোকে গুলি করে খুনের ঘটনায়। ২০১০-এর অক্টোবরে অযোধ্যা পাহাড়ে মাওবাদীদের হাতে খুন হন দুই বন্ধু— পুলিশ ইনস্পেক্টর পার্থ বিশ্বাস ও স্কুলশিক্ষক সৌম্যজিৎ বসু। ২০১২-তে ধরা পড়া অযোধ্যা পাহাড়ের শীর্ষ মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম জানিয়েছিলেন, তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও রঞ্জিত পাল ওই দু’জনকে খুন করেন ও সেই ব্যাপারে সম্মতি দেন কিষেণজি স্বয়ং।

বাঁকুড়া জেলার বারিকুল এলাকার খেজুরখেন্না গ্রামের রঞ্জিত ছিলেন সিপিআই (মাওবাদী)-এর রাজ্য মিলিটারি কমিশন ও দলের বাংলা-ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা বর্ডার রিজিওনাল কমিটির সদস্য। বছর একত্রিশের রঞ্জিত গত ১৭ বছর ধরে মাওবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রঞ্জিতের স্ত্রী ঝর্ণা নন্দীগ্রামের সোনাচুড়ার মেয়ে। দশ বছর আগে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে তিনি মাওবাদী স্কোয়াডে যোগ দেন। তিনি ছিলেন দলের দলমা-অযোধ্যা জোনাল কমিটির সদস্য ও অযোধ্যা এরিয়া কমিটির সম্পাদক। দলে তাঁর নাম হয় অনিতা। স্কোয়াডেই দু’জনের বিয়ে। ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে এক ডজন মামলা অনিতার বিরুদ্ধে। ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থ জানান, পশ্চিমবঙ্গে দু’বছরে আত্মসমর্পণ করা মাওবাদীর সংখ্যাটা দাঁড়াল ২১৯-এ।

মাওবাদীদের একটি সূত্রের খবর, ২০১১-য় কিষেণজি নিহত হওয়ার পর রঞ্জিত ও ঝর্ণা কিছু দিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। পরে ঝাড়খণ্ডে ঢুকে কাজ শুরু করেন। বারিকুল থানার এক ওসি এক বার বলেছিলেন, ‘‘রঞ্জিত ধরা দেবে না। প্রয়োজনে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করবে।’’ সেই রঞ্জিত পাল সস্ত্রীক ধরা দিলেন কেন? বিশেষ করে ঝাড়খণ্ড পুলিশের একটি সূত্রের যেখানে দাবি, রবিবারও রঞ্জিতকে ঘাটশিলার কাছে বুরুডি বাঁধ লাগোয়া একটি গ্রামে দেখা গিয়েছে!

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ঝাড়খণ্ডের ভূমিপুত্র মাওবাদীদের দাপটে দলে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন রঞ্জিতরা। অথচ বেশির ভাগ সময়ে সেই রাজ্যেই থাকতে হচ্ছিল। ঘনিষ্ঠ মহলে রঞ্জিত আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাঁকে দলের কেউই খুন করতে পারে। এই সুযোগই কাজে লাগিয়ে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর গোয়েন্দারা রঞ্জিতকে সস্ত্রীক আত্মসমর্পণে রাজি করান। লিখিত বিবৃতি পাঠের সময় রঞ্জিত-ঝর্ণা জানান, তাঁরা এসটিএফের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তখন সেখানে হাজির ছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার, এসটিএফের ডিসি মুরলিধর শর্মা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement