বছর চারেক আগে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের সেনা গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্নেল। আর তা ফলে গেল মাওবাদী মোকাবিলায় নরেন্দ্র মোদী সরকার সেনা ব্যবহার করা নিয়ে সদ্য একটি খসড়া নীতি তৈরি করার পর।
২০১০-এর শেষ দিক। উত্তাল জঙ্গলমহলে কলকাতা থেকে নিয়মিত যাচ্ছেন সেনা গোয়েন্দা অফিসারেরা। বিনপুর, লালগড়ে মাসোহারা দিয়ে স্থানীয় ‘সোর্স’ পর্যন্ত রেখেছিল সেনা গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু কেন এ সব? সেনাবাহিনী তো আর অভিযানে নামছে না! সেনা গোয়েন্দাদের শীর্ষে থাকা কনের্র্ল বলেছিলেন, “এখন হয়তো আমরা নেই। কিন্তু ভবিষ্যতেও যে থাকব না, সেটা কে বলতে পারে! নীতির বদল কোনও দিন হতেই পারে। সে কথা ভেবেই আমরা তৈরি থাকছি।”
মাওবাদী দমনে সেনা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদীর জমানায় কেন্দ্রের এই নীতির পরিবর্তন আসলে দ্বিতীয় ইউপিএ আমলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক রিপোর্টকেই শিরোধার্য করল বলে মনে করছেন সেনারা। একই মত কেন্দ্র ও রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা অফিসারদের একাংশেরও। ২০১২-তে তৈরি প্রায় দু’শো পাতার ওই রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, মাওবাদী দমনে রাজ্য পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী আদৌ যথেষ্ট নয়আফস্পা (আর্মড ফোর্সেস স্পেশ্যাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট) প্রয়োগ করে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় সেনা তো বটেই, বায়ুসেনাকেও নামাতে হবে। যদিও মাওবাদীদের দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় বিপদ বলে উল্লেখ করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। কিন্তু নানা যুক্তি তুলে তাঁর সরকার সেই সুপারিশ মানেনি।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই রিপোর্ট বলছে, ‘দুর্গম ঘন জঙ্গল এলাকায় মাওবাদী জঙ্গি-বিরোধী অভিযানে সিআরপি ততটা দক্ষ নয়। সিআরপি-র সীমাবদ্ধতার কথা দেশের নেতাদের বুঝতে হবে।’ ২০১০-এর এপ্রিলে ছত্তীসগঢ়ের দণ্ডকারণ্যে মাওবাদী হামলার মুখে এক সঙ্গে ৭৫ জন সিআরপি জওয়ান নিহত হন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘এই ধরনের হত্যালীলা চলতে থাকলে সিআরপি-র মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।’
মাওবাদী সন্ত্রাসের দরুণ ২০১৫ সালে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ খাড়া হতে পারে এবং তার মোকাবিলায় নিরাপত্তা বাহিনীর রণকৌশলই বা কী হবে, সে কথা মাথায় রেখে ওই রিপোর্ট তৈরি করা হয়। যেখানে বলা হয়, ‘মাওবাদী মোকাবিলায় শীঘ্র সেনা নামানো ছাড়া আমাদের আর কোনও বিকল্প থাকবে না। পৃথিবীর কোথাও পুলিশ দিয়ে এই ধরনের জঙ্গি সমস্যার মোকাবিলা করা হয় না। এটা সেনাবাহিনীরই কাজ। সেনা নামানোর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত যত তাড়াতাড়ি নেওয়া হবে, ততই মঙ্গল।’ রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে সচেতন হওয়াটা অবশ্যই জরুরি, কিন্তু মাওবাদীদের সম্পর্কে কল্পনাবিলাসী হয়ে পড়লে খুব বড় ভুল করা হবে।’
২০০৯-এর অক্টোবরে পশ্চিম মেদিনীপুরের সাঁকরাইল থানায় হামলা চালিয়ে দু’জন পুলিশ খুন এবং ওসি অতীন্দ্রনাথ দত্তকে অপহরণ করেছিল মাওবাদীরা। কিন্তু দু’দিনের মাথায়, ২২ অক্টোবর তাঁর হদিস পেয়ে লালগড়ের লক্ষ্মণপুরের জঙ্গল ঘিরে ফেলে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী। তাদের স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের পাল্লায় চলে এসেছিলেন কিষেণজি-সহ মাওবাদী শীর্ষনেতারা। শেষমেশ অতীনের প্রাণ বিপন্ন হবে আশঙ্কা করে অভিযান প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ওই অভিযানে সামিল এক আইপিএস অফিসারের কথায়, “শুধু যদি এক দল সেনা কমান্ডো থাকত! অতীনকে অক্ষত রেখেই তা হলে পশ্চিমবঙ্গের বুক থেকে সে দিন আমরা তামাম মাওবাদী চাঁইকে মুছে দিতে পারতাম।”
মাওবাদী দমনে সেনাবাহিনী নামানোর দাবি ছত্তীসগঢ় সরকার বহু বছর ধরেই করে আসছে। সে রাজ্যের দণ্ডকারণ্যেই এখন মাওবাদীদের ‘অপারেশনাল হেড কোয়ার্টার্স’। তবে মাওবাদীরা এ দেশের নাগরিক হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে আপত্তি তোলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তো বটেই, সেনার একাংশও। মাওবাদীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, এই যুক্তিও দেওয়া হয়েছিল সেনা না-নামানোর পক্ষে।
কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই রিপোর্টে রয়েছে, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের চেয়ে মাওবাদী আন্দোলন আরও বেশি বিপজ্জনক। মাওবাদীরা ভারতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থারই বিরোধী। তারা জম্মু ও কাশ্মীর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য চেয়েছে বলেও প্রমাণ মিলেছে।’
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ওই রিপোর্ট তৈরি করতে দিয়েছিল ‘সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ (ক্লজ)’-কে। এই ধরনের রিপোর্ট তৈরির বিষয়ে অভিজ্ঞ সংস্থাটির বিশেষজ্ঞরা মাওবাদী অধ্যুষিত বহু এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষ ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেন।
সেই রিপোর্টে দু’টি পর্যায়ে সেনা নামানোর সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথম দফায় সেনা অভিযান চলবে বস্তার ও দণ্ডকারণ্যে। জোরদার আক্রমণ হানতে বস্তারে সেনার দু’টি ডিভিশন অর্থাৎ অন্তত কুড়ি হাজারের বেশি সেনা নামানো উচিত। দ্বিতীয় পর্যায়ে ঝাড়খণ্ড ও বিহারের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকাগুলিতে সেনা নামবে। অভিযান চলাকালীন অতি দুর্গম এলাকায় সেনাদের নামাতে, অভিযানের আগে কোনও তল্লাটের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ও জখম জওয়ানদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতে বায়ুসেনা সাহায্য করবে। প্রয়োজনে হেলিকপ্টার থেকে মাওবাদীদের ঘাঁটিতে আঘাত হানার কথা ভাবা যেতে পারে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় অভিযান চালাতে অন্তত ছ’ডিভিশন সেনা প্রয়োজন হবে। আর সে জন্য সেনার অতিরিক্ত ছ’টি ডিভিশন গড়ে তুলতে হবে চিন সীমান্তের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে।
কিন্তু তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিই মাওবাদী দমনে সেনা ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এ বারের বিজেপি জমানায় তৈরি নতুন খসড়া নীতিটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দশটি মাওবাদী প্রভাবিত রাজ্যের মতামত চেয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই চিঠি পাঠাচ্ছে দিল্লি।
তবে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দতরের এক কর্তা জানান, মাওবাদী দমনে সেনা ব্যবহার না করার পক্ষেই সম্ভবত সওয়াল করবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কারণ জঙ্গলমহলে মাওবাদী হিংসাত্মক কার্যকলাপ এখন কার্যত বন্ধ এবং সেনা ব্যবহার না করেই সেই সাফল্য মিলেছে। দ্বিতীয়ত, জঙ্গলমহলের অনেকটা উন্নয়ন হয়েছে এই তিন বছরে। বরং, মাওবাদী সমস্যা সমাধানে পশ্চিমবঙ্গকে বাকি রাজ্যগুলি দৃষ্টান্ত হিসেবে অনুসরণ করুক, এমনটাই চাইবে রাজ্য সরকার।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, “সেনার কী দরকার? আধা সামরিক বাহিনীকে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারলে যে সাফল্য মেলে, পশ্চিমবঙ্গই তা দেখিয়ে দিয়েছে।”