মগরার চাঁপারুই গ্রামে বিকাশ ওরফে সুদীপ টুডুর বাড়ি।—নিজস্ব চিত্র।
আগে শুধু দেখেছেন। আর এখন তা ভেবে ভয়ে শিঊরে উঠছেন।
বস্তুত মাওবাদী ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ নেতা বিকাশ ও তার সঙ্গী ও স্ত্রী ধরা পড়ার পরে এমনটাই অবস্থা হুগলির মগরার চাঁপারুই গ্রামের মানুষের। কিষেণজির মৃত্যুর পরে পুলিশের হাত থেকে পালাতে জঙ্গলমহল ছেড়ে বছর কয়েক ধরে এই চাঁপারুইতেই নাম ভাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করেছিল বিকাশ (আসল নাম মনসারাম হেমব্রম)। সবাই তাঁকে চিনতো সুদীপ টুডু নামে। স্ত্রী ঠাকুরমণি হেমব্রমকে সবাই চিনতো ‘তারা’ নামে।
গত শনিবার সকালে কলকাতায় স্পেশাল টাক্স ফোর্সের হাতে গ্রেফতার হয় দু’জন। যদিও চাঁপারুইয়ে সুদীপ-তারার পড়শিদের দাবি. পুলিশ তাদের এখান থেকেই ধরে নিয়ে যেতে দেখেছে। যে বাড়িতে মাওবাদী দম্পতি থাকত সেখান থেকে একটি একে ৪৭ রাইফেল, কিছু কার্তুজ এবং কয়েকটি জংলা পোষাকও উদ্ধার করেছে পুলিশ।
পুলিশ গ্রেফতারের পর তাদের পড়শির পরিচয় জানতে পেরে এখন ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছেন চাঁপারুইয়ের বাসিন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, এতই সাধারণ ভাবে থাকত যে, ওরা যে এত ভয়ঙ্কর তা ওদের আচরণে কখনও বোঝা যায়নি। শনিবার সন্ধ্যায় যখন চাঁপারুইতে পৌঁছলাম তখন গ্রামে মাওবাদী দম্পতির মাটির বাড়ির পাশে জটলা।
পুলিশের বক্তব্য, মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় মগরার এই এলাকাকেই পুলিশের নাগাল এড়াতে বেছে নিয়েছিল বিকাশ। হাওড়া-বর্ধমান মেন শাখায় তালান্ডু স্টেশন লাগোয়া চাঁপারুইতেই থাকার জন্য বাসিন্দাদের কাছ থেকে খালপাড়েই জমি বেছে নেয় সে। জায়গাটা যথেষ্টই নির্জন। মগরার দিকশুই-হয়রা পঞ্চায়েতের এই গ্রামে ডিভিসি খালের পাড়ে দু’কাটা জমি কিনে একচালা মাটির বাড়ি তৈরি বাস করতে শুরু করে সুদীপ ও তারা। বাঁধের উপর থেকে ফুট চারেক নীচে বাড়ি। দিনের আলোয় জায়গাটি বোঝা গেলেও রাতের অন্ধকারে সহজে মালুম হবে না। দুই কামরার বাড়ি হোগলার উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে সামান্য শাক-সব্জিও চাষ করা হয়েছে। চারপাশে ঘুরে-বেড়াচ্ছে শ’খানেক মুরগি। হুট করে যাতে কেউ বাড়িতে ঢুকে পড়তে না পারে সে জন্য বাড়ির দেওয়ালের চারিদিকে কাঁটা গাছের ঝোপ তৈরি করা। ডিভিসি সেতু পার হয়ে ডানদিকের মোরাম রাস্তা ধরে ৩০০ মিটার মতো গেলেই বাঁদিকে বাড়িটা। আশপাশের বাড়ি বলতে ২০০ মিটার দূরে।
কেমন লোক ছিল ওরা?
স্থানীয় বাসিন্দা সুনীল কিস্কু বলেন, ‘‘খালপাড়ে বাঁধের পাশে নির্জন জায়গায় বাড়ি করেছিল। মানুষের সাথে খুব একটা মেলামেশা করত না। কিন্তু বাসিন্দাদের সাথে কোনও খারাপ ব্যবহারও করত না। বাইরে ব্রোলে দেখা যেত কোমরে চওড়া বেল্ট বাঁধা আছে। গায়ের লম্বা জামাটা প্যান্টের উপর দিয়ে ছাড়া থাকত। তা ছাড়া ওই মহিলা স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্বজিৎ পালের জমিতে ক্ষেত মজুরের কাজ করত। এতই সাধারণ ভাবে থাকত যে ও যে এতবড় জঙ্গিনেতা ছিল তা আমরা জানতে পারিনি। আমরা জানতাম ওর নাম সুদীপ টুডু।।’’
স্থানীয় বাসিন্দা জমির মালিক বিশ্বজিৎ পালের কথায়, ‘‘আমার জমিতে জন খাটত সুদীপের বৌ। কয়েক মাস ধরেই এখানে কাজ করছিলেন। কিন্তু আচরণে কিছুই বোঝা যায়নি। এখন সব শুনে ভয় লাগছে। পরে আমাদের উপর কোনও আঘাত হানবে না তো!’’
গত শুক্রবার থেকে এলাকায় পুলিশের গাড়ির টহল দেখেও গ্রামবাসীরা কিছু আন্দাজ করতে পারেননি। করবেনই বা কী করে! তাঁরা ভেবেছিলেন ভোটের জন্যই পুলিশের এই টহল। আসলে তা যে ওই দু’জনের জন্য তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি গোটা গ্রাম। তবে পুলিশি হানার একটা আতঙ্ক যে বিকাশের মধ্যে দানা বেঁধেছিল তা তার বাড়ির উপর নজর দিলেই বোঝা যায়। গোটা বাড়িটায় জানালা বলে কিছু নেই। ছোট্ট একটা ঘুলঘুলি। ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। তবে এতকিছুর পরেও পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেল না বিকাশ।