Patalpur Village

হাতির দাপটে ঘরছাড়া পটলপুর

উত্তরের তরাই বনাঞ্চলে, হাতির উপদ্রবে বনবস্তির মায়া ছেড়ে সরে যাওয়ার নজির রয়েছে, তবে তা নিতান্তই কয়েক ঘর মানুষের ছিন্নমূল-কাহিনী। কিন্তু দক্ষিণের রাঢ়ভূমে হাতির দৌরাত্ম্যে ভিটে-হারা হওয়ার এমন নজির আর নেই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

জামতাড়া (ঝাড়খণ্ড) শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:০৩
Share:

হাতির ভয়ে শূন্য গ্রাম। —নিজস্ব চিত্র।

ভরা শ্রাবণেও ছিপছিপে চেহারা ধরে রেখেছে সিদ্ধেশ্বরী। নদীর বাঁকে জল কম, বরং কাদা আর দুমকা পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা পাথরের দাপট বেশি। সেই ধূসর পাথরেই সাইকেলটা ঠেস দিয়ে ছেলেটি আঙুল উঁচিয়ে দেখায়, ‘‘ওই যে দেখছেন সার দেওয়া টিন-খড়ের চালা, ওটাই ছিল আমাদের গ্রাম। ওই ঝাঁকড়া পলাশের পাশেই যে উঁচু দাওয়া, ওটা আমাদের তিন পুরুষের ভিটে!’’ যা এখন আদ্যন্ত অতীত, বীরভূমের রাজনগর ব্লকের জনশূন্য এক গ্রাম পটলপুর।

Advertisement

গত দেড় দশক ধরে হাতির-হানায় একে একে গ্রাম ছেড়েছেন সকলেই। কাদা পথে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে প্রসেনজিত দাস বলছেন, ‘‘শেষ তিন বছরে গ্রামটা একেবারে খালি হয়ে গেল, এখন আর এক ঘর মানুষও নেই।’’ জনহীন গ্রামের ঘরে ঘরে এখন মরচে ধরা তালা, দাওয়ায় আশস্যাওড়ার ঝোপ, গৃহস্থের তুলসীতলায় আগাছার জঙ্গল।

উত্তরের তরাই বনাঞ্চলে, হাতির উপদ্রবে বনবস্তির মায়া ছেড়ে সরে যাওয়ার নজির রয়েছে, তবে তা নিতান্তই কয়েক ঘর মানুষের ছিন্নমূল-কাহিনী। কিন্তু দক্ষিণের রাঢ়ভূমে হাতির দৌরাত্ম্যে ভিটে-হারা হওয়ার এমন নজির আর নেই। ভূমি-রাজস্ব দফতরের নথিতে পটলপুর এখনও রয়ে গিয়েছে, তবে ঝাড়খন্ড সীমান্ত ছোঁয়া রাজনগর ব্লকের সেই ৭২ ঘরের বসত এখন আদ্যন্ত এক ‘নেই’ গ্রাম! পাঁচ বছর আগে বাপ-ঠাকুরদার পুরনো ভিটে ছেড়ে ১৩ কিলোমিটার দূরে রুহিদা গ্রামের উপান্তে ঘর বেঁধেছেন সুকুমার দাস। বলছেন, ‘‘পুরনো ভিটে কি ভোলা যায়! মাঝে মাঝে যাই, জমি জিরেতের হাল দেখে কান্না পায়!’’ জেলা সদরের মহকুমাশাসক অনিন্দ্য সরকার সদ্য ওই পদে যোগ দিয়েছেন। বলছেন, ‘‘পটলপুরের গ্রামছাড়া মানুষের বিষয়ে বিস্তারিত জানা নেই। তবে শুনেছি তাঁরা স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে গিয়েছেন। আমি নিজে গ্রামে গিয়ে এ ব্যাপারে খোঁজ নেব।’’

Advertisement

পটলপুরকে টিঁকিয়ে রাখতে হাতির হানা রোখার চেষ্টায় অবশ্য কসুর নেই বন দফতরের। রাজনগরের রেঞ্জ অফিসার কুদরাতে কোদা বলছেন, ‘‘রাতের পর রাত জেগে সীমানা পাহারা দিই। দফতরের বাঁধা বরাদ্দের বাইরেও নিজের গ্যাঁটের টাকা খরচ করে হুলা পার্টির (হাতি তাড়ানোর দলবল) রশদ জোগাড় করে হাতি ঠেকানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু হস্তিকুলকে আমরা ফিরিয়ে দিলে কী হবে, পরের রাতেই টিন পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে ও পারের প্রশাসন হাতির সেই দলকে ফের পটলপুরের দিকে ঠেলে দেয়।’’

অভিযোগের আঙুল পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের দিকে। অভিযোগ যে অমূলক নয়, ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া বন দফরের ডিএফও অজিঙ্কা দেবীদাসের কথায় তা স্পষ্ট, ‘‘বীরভূম সীমানায় জামতাড়ার বসতগুলিতে হাতি ঢুকলেই গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ করেন। তাঁদের পাশে থাকতে হয় আমাদেরও। মুখ ফিরিয়ে হাতি তখন পড়শি রাজ্যে পাড়ি দেয়।’’ তা হলে উপায়? হাতি বিশেষজ্ঞ সুধীর পট্টনায়েক বলেন, ‘‘ভূগোলের সীমানা তো হাতির চেনা নয়! তাদের করিডরে (চলাচলের পথ) আবাদ কিংবা বসত পড়লে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থাকেই। তবে ঠেলাঠেলি না করে দুই রাজ্যের বনকর্তারা যৌথ ভাবে আলোচনায় বসতে পারেন। পাশাপাশি গ্রামবাসীদেরও এমন আবাদের কথা ভাবা প্রয়োজন যা হস্তিযূথকে আকর্ষণ করবে না।’’ পটলপুরের উজ্জ্বল দাসের ১২ বিঘা জমি। বর্ষা অন্তে ধান ছাড়াও তাঁর আবাদে লাউ-কুমড়ো শীতের আলুর ফলন ছিল দেদার। বছর কয়েক আগে ‘কৃষক রত্ন’-এর মতো সরকারি সিলমোহর জুটেছে তাঁর কপালে। বলছেন, ‘‘সাবেক চাষের বাইরে বিকল্প কৃষির বিদ্যে কী আমাদের জানা আছে! আবাদে ধান-কুমড়ো ফলিয়েই কৃষকরত্ন পেয়েছিলাম। জানেন, গ্রাম ছেড়ে আসার সময়ে সেই পুরস্কারের ফলকটা বুকে ধরে এনেছি!’’

প্রসেনজিত, সুকুমার, উজ্জ্বল— পটলপুর এখন ছড়িয়ে গিয়েছে, সিউড়ি-রুহিদা-জয়পুরের আনাচেকানাচে। তবে, বুকে এখনও তাঁরা আঁকড়ে রয়েছেন তাঁদের ভিটে আর জমিজিরেত। আর, দূর থেকে বলছেন, ‘ওই যে আমাদের গ্রাম, ওখানেই আমাদের বাড়ি ছিল...।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement