বিধানসভায় মানস ভুঁইয়া। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
যেখানে দাঁড়াবেন অধীর চৌধুরী, বিপরীত বিন্দু খুঁজে নেবেন মানস ভুঁইয়া! প্রদেশ কংগ্রেসে জমে উঠেছে ইঁদুর-বিড়াল খেলা!
বিধানসভার পাবলিক অ্যাকউন্টস কমিটির (পিএসি) চেয়ারম্যান পদ নিয়ে টানাটানি চলছিলই। দলীয় নেতৃত্বের অবস্থান অগ্রাহ্য করে মানসবাবু কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িয়ে দেওয়া চেয়ারে বসতে গেলেন, তার জন্য সবংয়ের বর্ষীয়ান বিধায়ককে হাইকম্যান্ডের পরামর্শে কারণ দর্শানোর চিঠি ধরাতে চলেছেন অধীরেরা। সেই খবর পাওয়ার আগেই মানসবাবু আরও এক প্রস্ত উল্টো গেয়ে বসেছেন! ধর্মতলায় ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রী যে ভাবে বিজেপি-র বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন, তার জন্য মমতাকে দু’হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছেন মানসবাবু। ব্যাপার দেখে প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মনোজ চক্রবর্তী মন্তব্য করেছেন, ‘‘মানসবাবু আসলে ‘জে জে টি টি’! অর্থাৎ যখন যেমন, তখন তেমন!’’
কংগ্রেস এবং বাম বিধায়কদের অনুপস্থিতির মধ্যেও শুক্রবার মানসবাবু যথারীতি পিএসি-র বৈঠক করেছেন। বিধানসভায় বসেই
মমতার বিজেপি-বিরোধী জেহাদকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। চলেছেন নিজের খেয়ালেই। কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে অবশ্য বিষয়টা হাল্কা চালে নেওয়ার মতো নেই। পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক সি পি জোশীর সঙ্গে বৃহস্পতিবার দিল্লিতে অধীর ও বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের বৈঠক হয়। তাঁরা সনিয়া গাঁধীর সঙ্গেও আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সনিয়া পিএসি-র বিষয়টি দলের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীকে দেখতে বলেন। রাহুলের সঙ্গে এ দিন অধীর-মান্নানদের বৈঠকের পরে ঠিক হয়, মানসবাবুকে শো-কজ করা হবে। তার পরেও পিএসি-র পদ না ছাড়লে তাঁকে সাসপেন্ড করা হবে।
প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের রাহুল বলেছেন, যিনি যত বড়ই নেতা হোন না কেন, শৃঙ্খলা সকলকেই মানতে হবে। দলের শীর্ষ নেতা ও সাংসদদের সঙ্গে কথা বলে পিএসি-র পদটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল হাইকম্যাণ্ড। মানসবাবু অবশ্য বারেবারেই প্রশ্ন তুলে গিয়েছেন, পরিষদীয় দলে কেন এই নিয়ে কোনও আলোচনা হল না? কেনই বা দিল্লির সিদ্ধান্ত তাঁকে ডেকে আগাম জানিয়ে দিলেন না মান্নানেরা? তাঁকে শো-কজের সিদ্ধান্তের কথা জেনেও এ দিন মানসবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘কী চিঠি, কে লিখছেন, কী তার বয়ান, আগে দেখি। তার পরে যা বলার, বলব। তবে এটা বুঝতে পারছি, আমাকে দল থেকে তাড়ানোর জন্য অধীর-মান্নান একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এ কাজ করছেন!’’
তার আগে কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলে আরও একটি কাজ করেছেন মানসবাবু। ধর্মতলায় মমতার বক্তৃতার পরে বৃহস্পতিবারই তাঁকে ‘ভাল প্রশাসক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে এ দিন তিনি বলেছেন, ‘‘বিভেদকামী বিজেপি-র বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছেন, এক জন কংগ্রেস কর্মী হিসেবে তাঁকে ৫০০ বার সমর্থন করছি, করব।’’ বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের লড়াইকে ছায়াযুদ্ধ বলেই মনে করছেন অধীরেরা। তা জেনেও মানসবাবুর গলায় উল্টো সুর! তাঁর ব্যাখ্যা, জাতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেস বহু বছর ধরে লড়াই করছে। এটা রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের মাথায় রাখা উচিত। আর এখানে কেউ বিজেপি-র বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসাবে কংগ্রেসের তাকে সমর্থনই করা উচিত।
এরই মধ্যে আবার যে পিএসি নিয়ে গোলমালের সূত্রপাত, সেখানেও মানসবাবুর সঙ্গে সুজন চক্রবর্তীদের কিছুটা মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। বাম পরিষদীয় নেতা সুজনবাবু যানজটে আটকে পিএসি-র বৈঠকে যেতে পারেননি। পরে সুজনবাবু অভিযোগ করেন, শুক্রবারের বদলে অন্য দিন তাঁরা বৈঠক করার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু মানসবাবু স্পষ্ট জানিয়ে দেন, অন্য দিন বিধানসভায় বৈঠক করার জন্য ঘর পাওয়া যাবে না!
পিএসি-র বৈঠক ডাকছেন, তাতে বাম-কংগ্রেসের সহযোগিতা মিলছে না। শো-কজের পরে সাসপেনশনের খাঁড়াও ঝুলছে। মানসবাবুর তবে হবে কী? কংগ্রেসেরই একাংশের ধারণা, পিএসি-র যে পদের মেয়াদ এক বছর মাত্র, তার জন্য ‘অদৃশ্য’ সুতোর টানেই মানসবাবু প্যাঁচে ফেলছেন দলকে। তিনি যে গভীর জলের মাছ!