বাড়িতে ফেরার পরে সন্তানদের সঙ্গে রঘুপতি ওঁরাও। নিজস্ব চিত্র।
পুলিশ যে দিন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যায়, তখন মুখে একটিও শব্দ ছিল না। অথচ গাড়ি মাদারিহাট ব্লকে ঢোকার আগে থেকে সেই রঘুপতিই চালককে অনর্গল নির্দেশ দিচ্ছিলেন। আরও খানিকটা এগিয়ে টিনের চালার ইটের গাঁথনির সবুজ রঙের একতলা বাড়ি। চালককে সেখানে দাঁড়াতে বললেন। গাড়ি থেকে নেমেই ব্যস্ত পায়ে অভয় আর সরস্বতীর নাম ধরে হাঁকডাক জুড়ে দিলেন রঘুপতি (তিরকে) ওঁরাও। যেন সব ফেলে কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও গিয়েছিলেন।
তাঁর সুস্থতার এর থেকে ভাল প্রমাণ আর কিছু ছিল না, আড়াই বছর ধরে ঘর আগলে থাকা দুই কিশোর-কিশোরীর কাছে। বছর আড়াই পুরুলিয়ার মানসিক হাসপাতালে কাটিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন রঘুপতি। তাও পরিজনের হাত ধরে নয়। স্বেচ্ছায়। এখানেই জয় রঘুপতিদের মতো মানসিক রোগ থেকে সুস্থ হওয়া মানুষগুলোর।
২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইনে যুক্ত হয়েছে এই ‘ভলান্টারি ডিসচার্জ’ ব্যবস্থা। অর্থাৎ, রোগী সুস্থ হওয়ার পরে পরিবার তাঁকে নিতে না এলেও তিনি স্বেচ্ছায় ফিরতে পারবেন সমাজের মূল স্রোতে। সেইমতো সুস্থ হতেই রঘুপতির কথার সূত্রে তাঁর বাড়ি খুঁজে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জনমানস’ প্রকল্পের কোচবিহারের সদস্যেরা। জানতে পারেন, তাঁকে নিতে আসার মতো কেউ পরিবারে নেই। এর পরেই রঘুপতিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে সংস্থা তোড়জোড় শুরু করে।
ঘরে তো ফেরা হল। এর পর? তীব্র অভাবের জ্বালায় বড় ছেলে বছর ষোলোর কিশোর, এখন হান্টাপাড়া চা বাগানের শ্রমিক। রঘুপতিও যাতে হান্টাপাড়া টি এস্টেটে তাঁর কাজ ফিরে পান, সেই চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি দিন কয়েক বিশ্রাম নিয়ে কাজে যোগ দেবেন। জানালেন ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার শুক্লা দাস বড়ুয়া। তিনি বলেন, “বেশির ভাগ সময়ে কারও মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয় তাঁর কর্মক্ষমতা। ফলে সুস্থ সার্টিফিকেট পেলেও আত্মনির্ভর হওয়া নিয়ে সংশয়, তাঁর মূল স্রোতে ফেরার প্রক্রিয়া আটকে দেয়। তবে আমরা উদ্যোগী হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভলান্টারি ডিসচার্জ চালু করেছি। প্রথম দিকে অসুবিধা হলেও এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।”
এমন প্রচেষ্টার সাফল্যই জোড়া লাগিয়ে দেয় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি পরিবারকে, মানছেন শুক্লা এবং সংস্থার পুরুলিয়া জেলার অ্যাসোসিয়েট প্রোগ্রাম ম্যানেজার বিশ্বজিৎ পতি। বাবাকে ফিরে পেয়ে দুই সন্তানের মুখে স্বস্তির ছাপ, সেটাই বুঝিয়ে দেয়। মায়ের মৃত্যুর পরে বাবাই ছিলেন পাঁচ সন্তানের খুঁটি। থানা-পুলিশ করেও খোঁজ মেলেনি। অভিভাবকহীন হয়ে অর্থকষ্টে ছিটকে গিয়েছে সবাই। ঘর আগলে শুধু দুই কিশোর-কিশোরী।
বিশ্বজিতের কথায়, “স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত পুরুলিয়া মানসিক হাসপাতালে বাগান করায় রঘুপতির উৎসাহ ছিল দেখার মতো। চা বাগানে নিজের কাজ ফিরে পাওয়া নিয়েও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি।” আগে কি রঘুপতির মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল? ছেলে অভয় কেন বলে, “বাবা যেন নিয়মিত ওষুধ খান। সেটা আপনারা বুঝিয়ে বলে দিন। বাবার আগেও সমস্যা ছিল, কিন্তু ওষুধ না খেয়ে বাড়াবাড়ি হয়।” সংস্থা থেকে আশ্বাস দেওয়া হয় ছেলেকে। তাঁকে ও রঘুপতিকে বোঝানোর পাশাপাশি ওই সংস্থা, সদস্যদের তাঁকে ওষুধ খাওয়ানো এবং বছরে এক বার করে মানসিক চিকিৎসককে দেখানোর দায়িত্ব দিয়েছে।