গন্ধেশ্বরী নদীর জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে পথ ও ফুটওভার ব্রিজের একাংশ। মঙ্গলবার বাঁকুড়ার কেশিয়াকোলে অভিজিৎ সিংহের তোলা ছবি।
ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলে ডুবে যায় উদয়নারায়ণপুরের গ্রাম। এ বারের নিম্নচাপেও একই ছবি দেখেছে দক্ষিণবঙ্গ। আর তাতেই রীতিমতো ক্ষিপ্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বন্যাকে আবারও ‘ম্যান মেড’ বলে আখ্যা দিয়ে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, বাংলা-ঝাড়খণ্ডের মধ্যেকার বাঁধ, ব্যারাজগুলি থেকে বিনা নোটিসে জল ছাড়া হলে প্রয়োজনে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন।
এ দিন উত্তর দিনাজপুরের সোনাপুরে প্রশাসনিক বৈঠক করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকের মধ্যে কয়েক জন প্রশাসনিক কর্তা তাঁকে জানান, ডিভিসি আচমকা জল ছাড়ায় প্লাবিত হচ্ছে হাওড়া-হুগলির বিভিন্ন এলাকা। সূত্রের খবর, সব শুনে ক্ষোভ ফেটে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের শীর্ষ অফিসারেরা তাঁকে জানান, বিষয়টি নিয়ে সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনকে একাধিকবার বলা হলেও বিনা নোটিসে জল ছাড়ার প্রবণতা পুরোপুরি কমেনি। তখনই আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রশাসনিক বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের সামনে এসে মুখ্যমন্ত্রী ‘ম্যান-মেড’ প্রসঙ্গটি তোলেন। এর আগেও তিনি এই ধরনের বন্যাকে ‘ম্যান-মেড’ বলে ডিভিসি-কে তোপ দেগেছিলেন। তাঁর এই শব্দবন্ধকে বিরোধীরা কেউ কেউ কটাক্ষও করেছিলেন। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক কারণে বন্যা হওয়াটা আলাদা বিষয়। কিন্তু, কোথাও জলাধারের জল আচমকা ছেড়ে দিয়ে অন্য রাজ্যকে ভাসিয়ে দেওয়া হলে, সেটা প্রাকৃতিক বন্যা নয়। আমি সেটাকেই ‘ম্যান-মেড’ বন্যা বলি। ও রকম ‘ম্যান-মেড’ কাজ আমরা মানব না। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেব।’’
মুখ্যমন্ত্রী আরও দাবি করেন, ‘‘গত দু’বছর ধরে ডিভিসি যখন খুশি জল ছেড়ে দিচ্ছে। রাজ্য সরকারের মানা শুনছে না। আমরা সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনকে অভিযোগ জানিয়েছি। ওঁরা যদি মনে করেন, যখন খুশি জল ছেড়ে দিয়ে বন্যা করব, তা হতে দেব না।’’ এক সময় আক্ষেপও শোনা যায় তাঁর গলায়, ‘‘জলের অভাবে পুরুলিয়ায় খরা হয়, অথচ বাঁধের জল হুট করে ছেড়ে দিয়ে কোনও সংস্থা সব কিছু ভাসিয়ে দেয়! এটা দিনের পর দিন চলতে পারে না।’’
রাজ্য প্রশাসন সূত্রে খবর, ডিভিসি-র ছাড়া জলে মঙ্গলবার নতুন করে উদয়নারায়ণপুরের চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ডিভিসি সূত্রে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার তারা দু’টি জলাধার থেকে মোট ৩৬ হাজার কিউসেক জল ছেড়েছে। রবিবার নিম্নচাপের ফলে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে প্রবল বৃষ্টি হয়। তার ধাক্কায় সোমবার ডিভিসি-কে পাঞ্চেত এবং মাইথন জলাধার থেকে প্রায় ৪৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়তে হয়। মঙ্গলবার ওই দুই জলাধারে ৭১ হাজার কিউসেক জল ঢুকেছে। সেখানে জল ছাড়ার পরিমাণ অনেক কম, দাবি ডিভিসি-র। তাদের আরও বক্তব্য, মাইথন বাঁধের জল ধারণ ক্ষমতা ৪৯৫ ফুট। সেখানে প্রায় ৪৮৪ ফুট গভীরতা পর্যন্ত জল ধরে রাখা হচ্ছে। পাঞ্চেতেও ৪২৫ ফুট ক্ষমতার মধ্যে ৪২২ ফুট জল ধরে, বাকিটুকু ছাড়া হচ্ছে।
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী ডিভিসি-র বিরুদ্ধে যা কিছু বলেছেন, সে সম্পর্কে সংস্থার কর্তারা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাননি। শুধু ডিভিসি-র চেয়ারম্যান অ্যান্ড্রু ল্যাংস্টি জানিয়েছেন, জলাধারগুলি থেকে জল ছাড়ার ক্ষেত্রে যা কিছু সিদ্ধান্ত, সবই নেয় ‘দামোদর ভ্যালি রিজার্ভার রেগুলেশন কমিটি’। সেই কমিটির মাথায় থাকেন সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের সদস্য সচিব। তিনি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডের এক জন করে সরকারি প্রতিনিধিও থাকেন কমিটিতে। কোন দিন, কখন, কত জল ছাড়া হবে, তাঁরাই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। সেই নির্দেশ মতোই ডিভিসি জল ছাড়ে। সরাসরি না বললেও মুখ্যমন্ত্রীর ‘না জানিয়ে জল ছাড়া’ সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডিভিসি-র কর্তাব্যক্তিদের একাংশের বক্তব্য, ‘‘আমরা সব সময়ই বলে আসছি, রাজ্যকে আগাম না জানিয়ে কোনও জলাধার থেকে জল ছাড়া হয় না, কোনও দিন হবেও না। নির্দিষ্ট ‘গাইডলাইন’ মেনেই সব সময় জল ছাড়া হয়।’’ বরং মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে ডিভিসি-কে দুষেছেন, তাতে সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের একাংশ হতাশ বলেই জানাচ্ছে সংস্থার একটি সূত্র। ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁরা বলেছেন, অগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে বৃষ্টিপাতের ফলে ডিভিসি-র জলাধারগুলিতে প্রচুর জল ঢুকেছে। সে তুলনায় ছাড়া হয়েছে অনেকটাই কম। জলাধারগুলির সর্বোচ্চ ক্ষমতা পর্যন্ত জল ধরে রাখার চেষ্টা চলছে। তবুও বারবার তাদের দোষের ভাগী হতে হচ্ছে!