কেন্দ্রীয় সরকারের দাদাগিরির বিরুদ্ধে দিল্লির বুকে দাঁড়িয়ে চরম জেহাদ ঘোষণা করলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, রাজ্যগুলির প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দীর্ঘদিন বাদে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আজ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে পাক্কা দু’ঘণ্টা আলোচনা করলেন আগামী দিনের রণকৌশল নিয়ে। কথা বলার কথা আপ শীর্ষনেতা অরবিন্দ কেজরীবালের সঙ্গেও। সব মিলিয়ে এ বারের দিল্লি সফরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের বিউগলই বাজিয়ে দিলেন তৃণমূল নেত্রী। এটাও স্পষ্ট করে দিলেন, তিনি থাকবেন কৃষ্ণের ভূমিকায়, সারথি হিসেবে।
আগামিকাল বেলা সাড়ে তিনটেয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংসদে ও তার আগে দেড়টা নাগাদ অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির বাড়িতে বৈঠক করবেন মমতা। দুই বৈঠকেই রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণ নিয়ে সরব হবেন মুখ্যমন্ত্রী। দশ দিন আগে আন্তঃরাজ্য পরিষদের বৈঠকেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এই সুর বেঁধে দিয়েছিলেন মমতা।
দ্বিতীয় বার বিপুল ভাবে জিতে ক্ষমতায় আসার পর মমতার পাখির চোখ এখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচন। এখন থেকেই তিনি চাইছেন একটা অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি ফেডারেল ফ্রন্ট-এর প্রস্তুতি শুরু করতে।
তবে মমতা যে সেই ফ্রন্টের প্রধান মুখ হবেন না, তা আজ স্পষ্ট করে দিতে চেয়ে বলেছেন, ‘‘আমি নেতৃত্ব দেওয়ার কে? আমার চেয়েও যোগ্য লোক রয়েছেন। নীতীশ কুমার ভাল কাজ করছেন। আমি পিছনেই থাকতে ভালবাসি।’’ কিন্তু তিনি মুখে পিছনে থাকার কথা বললেও আজ দেখা গেল তিনিই রয়েছেন অগ্রণী ভূমিকায়। আপ বা নীতীশের জেডিইউ-এর মতো দলও মনে করে সব ক’টি সমমনস্ক দলকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার প্রশ্নে মমতাই এই মুহূর্তে সেরা রাজনীতিক। সে কথা আজ রাতে মমতার সঙ্গে বৈঠকে তৃণমূলের নেতাদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছেন নীতীশও। নীতীশ আজ দলীয় কাজে লখনউ গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সোজা চলে যান দিল্লিতে মমতার বাসভবনে। বৈঠকের পরে মমতা-নীতীশ কেউই রাতে সাংবাদিকদের সামনে আসেননি।
ফেডারেল ফ্রন্ট-এর জমি তৈরির কাজ শুরু করে মমতা কাল নামছেন রাজ্যের হক আদায়ের লড়াইয়ে। তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, আগামিকাল প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী— দু’জনের সঙ্গে বৈঠকেই জানানো হবে রাজ্যের ঘাড়ে চেপে থাকা ঋণের বিষয়টি। মমতার হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ে এখন ৩ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকার দেনা। কেন্দ্র এই দেনার দায় নিয়ে যাতে রাজ্যের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে, তার জন্য দরবার করবেন তিনি। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের পর রাজ্যের কোষাগারে বাড়তি অর্থ দেওয়া হচ্ছে— কেন্দ্র এই দাবি করলেও তা যে আসলে স্রেফ হিসেবের কারসাজি সেটা জেটলিকে স্পষ্ট ভাবে জানাবেন মমতা। রাজ্য সরকারের মতে, এই কমিশনের পরেও ৩৯টি কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অর্থ দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ৫৮টি প্রকল্পে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় অনুদান।
মমতা আজ সেন্ট্রাল হলে বলেন, ‘‘ওরা যা খুশি তাই করছে। আগে যেখানে কোনও প্রকল্পের ৯০% অর্থ কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছিল, এখন সেখানে রাজ্যকেই দিতে হচ্ছে ৯০%। একই ভাবে বেশ কিছু প্রকল্পে আগে যেখানে কেন্দ্র দিত ৬০%, রাজ্য ৪০%, এখন তা উল্টে গিয়েছে।’’ মমতার আরও অভিযোগ, বেশ কিছু কেন্দ্রীয় সংস্থার সদর দফতর কলকাতা থেকে সরিয়ে দেওয়ারও চক্রান্ত করছে কেন্দ্র। এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘এদের এখন চোখে পড়েছে টি বোর্ড। অসমের ভোটে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল টি বোর্ডের সদর দফতর গুয়াহাটিতে সরিয়ে নেওয়া হবে। তলে তলে সেই প্রক্রিয়া শুরুও করে দিয়েছে কেন্দ্র। মমতা বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই কলকাতার দফতরের গুরুত্ব কমাতে ১৯ জনকে গুয়াহাটি বা দিল্লিতে বদলি করে দেওয়া হয়েছে।’’ পোর্ট ট্রাস্টের মতো সংস্থাগুলির শীর্ষকর্তা নিয়োগ নিয়েও রাজ্যের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না দিল্লি— এই সব নিয়ে সরব হওয়ার পাশাপাশি আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করে দেওয়া, কেরোসিনে ভর্তুকি কমানোর মতো বিষয় নিয়েও সরব হবেন মমতা।