বিধানসভা ভোটে প্রবল তৃণমূলী ঝড়ে বাংলার রাজনীতিতে এমনিতেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন বামেরা। সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনের ফলে তা আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। নোট-দুর্ভোগকে সামনে রেখে এ বার কার্যত বামেদের ভিটেমাটির দখল নিতে মাঠে নামছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন্দ্রের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোমবার রাজ্যে ১২ ঘণ্টা হরতালের ডাক দিয়েছে বামদলগুলি। শুক্রবার সন্ধ্যায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে সেই ঘোষণা হতেই তীব্র আপত্তি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, ‘‘বন্ধ বরদাস্ত করব না।’’ শুধু সেখানেই থেমে থাকলেন না মমতা। বরং তাঁর কৌশলী সিদ্ধান্ত— বিমান-সূর্যকান্তরা যখন ঘুরেফিরে হরতালের আশ্রয় নিচ্ছেন, তখন নোট-হয়রানির আন্দোলনকে তিনি নিয়ে যাবেন শ্রমিক-মজুরদের মাঝে। বেছে বেছে সেই সব জায়গায় তৃণমূল তাদের এই আন্দোলকে নিয়ে যাবে, যেখানে ঐতিহাসিক ভাবেই এক সময় দুর্জয় ঘাঁটি ছিল বামপন্থীদের।
শনিবার দুপুরে নিজের কালিঘাটের বাড়িতে দলের কোর কমিটির বৈঠক ডাকেন তৃণমূলনেত্রী। আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেই বৈঠক শেষ হয়ে যায়। তার পরই দলের তরফে ঘোষণা করা হয়, নোট বাতিলের প্রতিবাদে বিড়ি শ্রমিক, চা বাগানের কর্মী, চটকল ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজুর এবং কৃষকদের নিয়ে আলাদা ভাবে আন্দোলনে নামবে তৃণমূল। এ নিয়ে একগুচ্ছ কর্মসূচিও এ দিন ঘোষণা করেছে তারা। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের হয়রানির প্রতিবাদে কলকাতায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আঞ্চলিক শাখা ও সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখার সামনে আলাদা ভাবে ধর্নায় বসবে দল। সোমবার মমতার নেতৃত্বে কলেজ স্কোয়ার
থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিলের ঘোষণা আগেই করেছে তৃণমূল।
বস্তুত বামেরা হরতালের ঘোষণা করার পর থেকেই ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী, শিল্পমহল থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে। এমনকী তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বামেদের ভিতর থেকেও অন্য সুর শোনা যাচ্ছে। অনেকের মতে, শুধু সাংগঠনিক ভাবেই বামেরা
রুগ্ণ হয়ে পড়েননি, তাঁদের চিন্তাভাবনাতেও দৈন্য চলছে। না হলে নোট বাতিলের ধাক্কায় এমনিতেই যখন কাজ-কারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে, তখন কেউ হরতাল ডাকে!
তৃণমূল নেতৃত্বের মতে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা প্রথম থেকেই বন্ধের তীব্র বিরোধী। তা ছাড়া সর্বস্তরে বামেদের হরতালের সমালোচনা
পথে প্রতিবাদে
২৮ নভেম্বর: কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিক্ষোভ-মিছিল
২৯ নভেম্বর: সব চা বাগানের সামনে চা শ্রমিকদের বিক্ষোভ-সভা
৩০ নভেম্বর: মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানে বিড়ি শ্রমিকদের সমাবেশ
১ ডিসেম্বর: কলকাতায় টি-বোর্ডের সামনে চা-শ্রমিকদের ধর্না
২ ডিসেম্বর: রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে কৃষক, সমবায় ব্যাঙ্ক কর্মীদের সভা
৫ ডিসেম্বর: সল্টলেকে জুট কমিশনারের অফিসের সামনে বিক্ষোভ
৬ ডিসেম্বর: গাঁধী মূর্তির সামনে জাতীয় সংহতি দিবস পালন
শুরু হওয়ায় রাজনৈতিক ভাবে আরও সুবিধা হয়েছে তাঁর। সূত্রের মতে, এ দিনের বৈঠকে মমতা বলেন, ওঁদের পাশে কেউ নেই। ফলে হরতাল সফল হওয়ার প্রশ্ন নেই। তবুও দেখতে হবে জনজীবন যেন স্বাভাবিক থাকে। স্কুল, কলেজ, সরকারি অফিস, দোকানপাট যেন খোলা থাকে। তবে এ জন্য কোনও ভাবে সংঘাতের পথে যাওয়া চলবে না। সাংগঠনিক শক্তি দিয়েই তা সুনিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সফল করতে হবে সোমবারের মিছিলকেও।
রাজ্য জুড়ে এই আন্দোলনের ডাক দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় স্তরে নিজের কর্মসূচি নিয়েও অবিচল নেত্রী। বৈঠকের পর দলের তরফে এও জানানো হয়, সোমবারের মিছিল শেষ করেই লখনউয়ের উদ্দেশে রওনা দেবেন নেত্রী। মঙ্গলবার লখনউতে তাঁর সভা। পরের দিন, বুধবার পটনায় সভা করে কলকাতায় ফেরার কথা তাঁর। এ ছাড়া ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশাতেও নোট বাতিলের বিরোধিতায় সভা করবে তৃণমূল। বিভিন্ন রাজ্যে এই সব সভার জন্য দলের নেতাদের দায়িত্বও ভাগ করে দিয়েছেন তিনি।
যদিও তৃণমূলের এই সব সভার কতটা প্রভাব ওই রাজ্যগুলিতে পড়বে তা নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরে অনেকের সংশয় রয়েছে। তবে মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতা এ দিন বলেন, ‘‘দিদিও জানেন, ওই সভায় তেমন ভিড় হবে না। জাতীয় স্তরে তাঁর নেতৃত্ব সবাই মেনে নেবেন এমন ভ্রান্তিবিলাসও মমতার নেই। উনি শুধু জাতীয় স্তরে তাঁর উপস্থিতিটুকু জানিয়ে রাখছেন।’’ ওই নেতার বক্তব্য, মমতার প্রাথমিক লক্ষ্য হল আসন্ন লোকসভা ভোটে বাংলায় ৪২টি আসনের সবক’টিই দখল করা। বিজেপি রাজ্যে জমি পেলেও তা কেড়ে নিয়েই এই কাজ করা। যাতে কেন্দ্রে মিলিজুলি সরকার তৈরির পরিস্থিতি হলে তৃণমূলের গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে ওঠে। আর সেই কারণেই নোট দুর্ভোগ নিয়ে সমাজের সব অংশকে পাশে পেতে নেমেছে তৃণমূল। দলের আগামী সব কর্মসূচির মধ্যে সেই উদ্দেশ্যটাই স্পষ্ট।