অসন্তোষ চাপতে পারলেন না মুখ্যমন্ত্রী।
একশো দিনের কাজে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকে কী রকম অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে— সে কথা বলছিলেন মমতা। আচমকাই অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের কাছে তিনি জানতে চাইলেন— এখন রাজ্যের কত পঞ্চায়েতে ব্যাঙ্ক নেই?
হাতের কাছে মাইক ছিল না। একটু সময় নিয়ে মাইক জোগাড় করে মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘‘২০১১ সালে আপনি যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন এক হাজার পঞ্চায়েত ব্যাঙ্কহীন ছিল! এখন তা কমে হয়েছে ৭১৬।’’
শুনেই ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারের ১০০ তম প্রশাসনিক বৈঠকে মন্ত্রিসভার অন্য সদস্য ও আমলাদের সামনেই অর্থমন্ত্রীকে বলেন, ‘‘তার মানে, চার বছরে মাত্র পৌনে ৩০০ ব্যাঙ্ক হয়েছে? কোনও কাজই তো হয়নি!’’
ভরা হাটে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এই কথা শুনে খানিকটা থতমত খেয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেন অমিতবাবু। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে মঞ্চের সামনে বসা সরকারের লিড ব্যাঙ্ক ইউবিআই-এর এগ্্জিকিউটিভ ডিরেক্টরকে অনুরোধ করেন মমতা, ‘‘গ্রামেগঞ্জে যাতে আরও বেশি ব্যাঙ্ক খোলা যায়, সেটা দেখুন।’’
এগ্্জিকিউটিভ ডিরেক্টর মাথা নেড়ে সায় দেন। বছর খানেক আগে নবান্নে এই সমস্যা নিয়ে বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ব্যাঙ্ক গড়তে জমির সমস্যা হলে সরকার পঞ্চায়েত অফিসে জায়গা দেবে। সেখানে শাখা খুলবে ব্যাঙ্ক। তাও কাজে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি দেখে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ব্যাঙ্ক যত বাড়বে, চিট ফান্ডের রমরমাও তত কমবে।’’
প্রায় একই অবস্থা জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রেরও। দফতরের সচিব নবীন প্রকাশের কাছে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান— ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্পে এ পর্যন্ত কতগুলি পুকুর কাটা হয়েছে? প্রশ্ন শুনে সচিব তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছেন দেখে সৌমেনবাবুকেই প্রশ্ন করলেন মমতা। কিন্তু এ বারেও সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে নিজেই উত্তর দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, ‘‘পুকুর কাটায় আমরা লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে গিয়েছি। কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। আরও পুকুর কাটতে হবে। তাতে মাছ চাষও শুরু করতে হবে।’’ কী ভাবে তা হবে, তার রূপরেখা তৈরি করতে বললেন মত্স্যসচিবকে।
নবীন প্রকাশ কোনও রকমে বেঁচে গেলেও নিজের দফতরের কাজ নিয়ে কার্যত অগ্নিপরীক্ষা দিতে হল কারিগরি শিক্ষা দফতরের সচিব হৃদেশ মোহনকে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কাছে জানতে চান— বর্ধমানে আইটিআই তৈরির কাজ কত দূর এগিয়েছে? হৃদেশ জানান, শেষের মুখে।
সে কথা শুনেই মুখ্যমন্ত্রী বলে ওঠেন, ‘‘মেমারির বিডিও কোথায়?’’ বিডিও উঠে দাঁড়াতেই মমতা জানতে চান, ‘‘কী, সচিব ঠিক বলেছেন?’’ তত ক্ষণে হৃদেশের কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। বিডিও মাথা নেড়ে কারিগরি শিক্ষা সচিবের বক্তব্যকে সমর্থন করায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন শিক্ষাসচিব। নিশ্চিন্ত হতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকেও।
মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার কিছু দিনের মধ্যেই জেলায় জেলায় ঘুরে প্রশাসনিক বৈঠক করা শুরু করেন মমতা। বুধবার ছিল ১০০ তম বৈঠক। সেই উপলক্ষে বর্ধমান শহর সেজে উঠেছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাট আউট, ফেস্টুন ও ব্যানারে। সঙ্গে বিশাল বিশাল তোরণ। শুধু শহর বা তার লাগোয়া এলাকাই নয়, প্রশাসনিক বৈঠককে সামনে রেখে ভোট-প্রচারের কায়দায় কলকাতা থেকে সিঙ্গুর, ধনেখালি, পালসিট হয়ে বর্ধমান পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে লাগানো হয়েছিল বর্তমান সরকারের নানাবিধ ‘কৃতিত্বের’ খতিয়ান। ছিল মুখ্যমন্ত্রীর বড় বড় ছবি দিয়ে এই শততম বৈঠকের প্রচারও। কোথাও ফেস্টুনের সৌজন্যে বিধায়ক, কোথাও বা জেলা পরিষদের সদস্য। পালসিট পেরোতেই যুবশ্রী, কন্যাশ্রী, নির্মল বাংলা, কর্মতীর্থ ও গতিধারার মতো সরকারি প্রকল্পের ঢালাও প্রচার। এখানে অবশ্য সৌজন্যে ‘বর্ধমানের নাগরিকবৃন্দ’। কারা তাঁরা? প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, যে হেতু বর্ধমানের বৈঠকটি পুরোদস্তুর প্রশাসনিক, তাই নাগরিকবৃন্দের নামে তৃণমূলই ওই সব ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়েছে।
মমতার ১০০ তম প্রশাসনিক বৈঠক সফল করতে এ দিন যেমন আমলাদের ব্যস্ততার শেষ ছিল না, তেমনই নতুন নতুন ভাবনা কাজে লাগিয়ে অনুষ্ঠানকে জমকালো করে তুলতে চেষ্টার অন্ত ছিল না তাঁদের। এরই মধ্যে সরকারের কাজে ‘স্বচ্ছতা’ প্রমাণে এ দিনের বৈঠককে খোলা দাওয়ায় নিয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ ধরনের বৈঠক যেখানে ঘেরাটোপে হওয়াটাই দস্তুর, সেখানে মমতার নির্দেশে গোটা বৈঠকের সাক্ষী থাকলেন প্রশাসনের বাইরের লোকজনও। এমনকী, মমতার নির্দেশে বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থাও করে প্রশাসন। তাই গত প্রশাসনিক বৈঠকগুলিতে কিছু দফতরের কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে মন্ত্রী-সচিবদের যেমন বকাঝকা করেছিলেন, এ দিন সে ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনের একাংশের ধারণা, সেই সতর্কতা থেকেই অধিকাংশ মন্ত্রীকে বলার সুযোগ দেননি মমতা।
বছর ঘুরলেই বিধানসভা ভোট। সেই কারণে আগামী বছরের শুরু থেকেই জেলাশাসকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজে। তার আগেই যে মুখ্যমন্ত্রী উন্নয়নের নির্ধারিত কাজকর্ম শেষ করতে চাইবেন, এমনটা আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলেন রাজ্যের আমলারা। তাই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী কাজের সময়সীমার প্রসঙ্গ তুললেই অনেক সচিব ডিসেম্বরকে সময়সীমা হিসেবে উল্লেখ করেন। খাদ্যসচিব অনিল বর্মাও খানিকটা সেই সময়সীমা অনুমান করে মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, ডিসেম্বরের মধ্যেই তাঁরা ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরির কাজ শেষ করে ফেলবেন। মুখ্যমন্ত্রী তত ক্ষণে ঘোষণা করে ফেলেছেন, ন’কোটি মানুষের মধ্যে ছ’কোটিকেই তিনি দুই বা তিন টাকা কিলো দরে চাল দেবেন। ডিজিটাল রেশন কার্ড না হলে সে কাজে দুর্নীতি হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী অনিলবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘অত সময় দেওয়া যাবে না। অক্টোবরেই শেষ করতে হবে।’’
বৈঠক শুরু হওয়ার কথা ছিল দুপুর ২টোয়। কিন্তু তার আধ ঘণ্টা আগেই মঞ্চে উঠে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ‘পিএম টু ডিএম’ আলোচনা শুরু করেছিলেন। কোনও কোনও মুখ্যমন্ত্রী দু-এক বার জেলায় গিয়ে বৈঠক করেছেন। ‘‘কিন্তু আমার মতো সিএস থেকে বিডিও, ডিজি থেকে আইজি— সবাইকে নিয়ে গিয়ে সরকারি কাজের পর্যালোচনা কেউ করেনি। টানা চার বছর ধরে তো করেইনি’’— দাবি মমতার। বাম সরকারের সমালোচনা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আগের জমানায় গ্রাম পিছিয়ে ছিল। পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতেই সমস্ত খরচ হতো। পরিকল্পনা খাতে খরচই হতো না। আমি সে সব বদল করেছি। আমি নতুন ত্রিস্তর প্রশাসন তৈরি করেছি। রাজ্য-জেলা-ব্লক।’’ মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য শুনে প্রশাসনের একাংশই বলছেন, তবে কি মমতা ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পাল্টা ত্রিস্তর প্রশাসনিক ব্যবস্থা চাইছেন?
বর্ধমানে লোক সংস্কৃতি মঞ্চে টানা দু’ঘণ্টা প্রশ্নোত্তর চলার পরে শেষের ৩০ মিনিট চলে পরিচয় পর্ব। মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান— পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিরা সবাই এসেছেন? তাঁরা আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিতি জানান দেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের বলেন, ‘‘আপনারাই সভাপতি? আপনাদের তো বেশ ভাল অবস্থা দেখছি!’’ শিক্ষা জগতের বিশিষ্টরা ছাড়াও ওই পর্বে অংশ নেন বর্ধমান জেলার সব থানার ওসি। সকলেই মুখ্যমন্ত্রীকে নিজেদের নাম বলে কোন থানায় কর্তব্যরত তা জানান। এ দিন নবান্ন থেকে চারটে বাসে চাপিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তা এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বর্ধমানে নিয়ে আসে সরকার। সেই দলে ছিলেন অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া, কবি সুবোধ সরকার, বন্ধন ব্যাঙ্কের কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ-সহ বিশিষ্ট জনেরা। তাঁরা সকলেই আপ্লুত কণ্ঠে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করেন।
ল্যাংচা-হাব পরিকল্পনা
ভাবনাটা মাথায় এসেছিল বুধবার বর্ধমানের প্রশাসনিক বৈঠকে যাওয়ার পথেই। শক্তিগড়ে পথের দু’ধারে সারি সারি ল্যাংচার দোকান দেখেই সেখানে ‘ল্যাংচা হাব’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা ঝিলিক দেয়। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। প্রশাসনিক বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন সে কথা। দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ক্ষুদ্রশিল্প সচিবকে উদ্যোগী হতে বলেন তিনি। ফিরতি পথে শক্তিগড়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। একটি দোকানের সামনে রাস্তায় চেয়ার পেতে বসে আশপাশের ল্যাংচার দোকানগুলির মালিকদের ডেকে পাঠান। ‘ল্যাংচা হাব’ তৈরির কথা জানিয়ে মমতা বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে আপনাদের কোনও প্রস্তাব বা পরিকল্পনা থাকলে দশ দিনের মধ্যে মুখ্যসচিবকে জানান।’’ প্রশাসন সূত্রের খবর, ‘ল্যাংচা হাব’-এ এক ছাদের নীচে মিলবে শক্তিগড়ের ল্যাংচা এবং বর্ধমানের মিহিদানা-সীতাভোগ। ‘বিশ্ব বাংলা’ ব্র্যান্ডিং-এ এটি সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।