প্রায় দেড়শো বছর আগে নেপালের আদি কবি ভানুভক্ত আচার্য সংস্কৃত রামায়ণের প্রথম নেপালি অনুবাদ করেছিলেন। সমন্বয়ের বার্তা নিয়ে আগামী কাল, ১৩ জুলাই রাজ্য আয়োজন করছে ভানুভক্তের জন্মবার্ষিকী। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সামনে রেখে অনুষ্ঠান হচ্ছে দার্জিলিঙের ভানুভবনে, যার আজকের নাম গোর্খা রঙ্গমঞ্চ।
গত বছরও ভানুভক্তের জন্মবার্ষিকী পালন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এ বার খোদ দেশের প্রথম নাগরিক আসবেন শুনে বিমল গুরুঙ্গ চেয়েছিলেন জিটিএ-র তরফ থেকে এই মহাকবির জন্য একটি পৃথক অনুষ্ঠান করতে। তিনি চেয়েছিলেন, সেখানেও প্রণববাবু আসুন। আনুষ্ঠানিক ভাবে চিঠি তৈরির আগে প্রণববাবুর কাছে এই অনুরোধ জানিয়ে বার্তা পাঠান গুরুঙ্গ। কিন্তু রাষ্ট্রপতি দূত মারফত গুরুঙ্গকে বোঝান, রাজ্য সরকার যখন একটি অনুষ্ঠান করছে তখন সেখানে সমবেত ভাবে শামিল হওয়াটাই সাংবিধানিক শিষ্টাচার। গুরুঙ্গ এ প্রস্তাব মেনে নেন।
অক্টোবরে দার্জিলিংয়ে পুরভোট। গুরুঙ্গ-ঘনিষ্ঠ মহলই বলছে, কালিম্পং তো বটেই, দার্জিলিং ও কার্শিয়াঙেও এ বার তাদের অবস্থা খারাপ। এমন পরিস্থিতিতে মমতা নিজেই রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে জনপ্রিয় নেপালি কবির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গকে ভাগ হতে না দেওয়ার বার্তাকে জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। গুরুঙ্গকে পুরোপুরি রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এখন কেন্দ্র ও রাজ্য ঐক্যবদ্ধ। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় নবনিযুক্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে চিঠি দিয়ে এই অনুষ্ঠানে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতির এই দ্বিতীয় দার্জিলিং সফরে তাই ঐক্যই সব থেকে বড় বার্তা। এর আগে নেপালি ভাষাকে অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন চালান সুবাস ঘিসিঙ্গ। সংসদে সেটি অন্তর্ভুক্ত করাও হয়েছে। পরে দার্জিলিঙের স্কুলে বাংলা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, এই ধুয়ো তুলে গুরুঙ্গ আন্দোলন করতে যান। কিন্তু মহাকবির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের মধ্যে দিয়ে ভাষাভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদের মানসিকতাকেও নিস্তেজ করে দিতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বিজেপির কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃত্ব বলছেন, গুরুঙ্গের প্রধান সমস্যা হয়েছে তিনটি। প্রথমত, আন্দোলন গড়ে তোলার সাংগঠনিক শক্তি গুরুঙ্গ হারিয়েছেন। তাঁর দল ভেঙে গিয়েছে। জনসমর্থনও কমেছে। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন থেকে সরে এখন তিনি আর্থিক দাবিতেই সরব। দ্বিতীয়ত, জিটিএ স্বয়ংশাসিত সংস্থা হওয়ার পরেও দার্জিলিঙে দারিদ্র ঘোচেনি। গুরুঙ্গ বেকারদের চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারছেন না। উল্টে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তৃতীয়ত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেলা প্রশাসন জেলাশাসকের মাধ্যমে অতিসক্রিয়। কার্যত সেটিই প্রধান প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে গুরুঙ্গ একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে দার্জিলিঙে রাষ্ট্রপতি ও মুখ্যমন্ত্রী, দু’জনের সঙ্গেই বৈঠক করবেন।
আগামিকাল দার্জিলিঙের মাটিতে সরকারি সংবর্ধনা দিয়ে শুধু বাঙালি রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন নয়, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের এক প্রধান চরিত্রকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে মমতা অখণ্ডতার বার্তাটি দিতে চাইছেন। ১৪ জুলাই দার্জিলিং চা সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক ও বিশেষ অধিবেশন। চা শিল্পের সঙ্কটকেও গুরুত্ব দিতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই মঞ্চেও রাষ্ট্রপতিকে রাখার পরিকল্পনা হয়েছে। চা শিল্পে বেশ কিছু ব্যবসায়ী শ্রমিক-বিরোধী কার্যকলাপ করছেন বলে অভিযোগ। বহু চা-বাগান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই কারণে মুখ্যমন্ত্রী এর আগে একটি চা বাগানের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এখন জানা যাচ্ছে, তৃণমূলেরই এক রাজ্যসভা সাংসদের কোম্পানির হাতে বেশ কয়েকটি চা বাগান রয়েছে। যার মধ্যে তিনটি বন্ধ। শ্রমিক অসন্তোষ তীব্র। চা শিল্পের এই সঙ্কটকে গুরুঙ্গ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করতে চান। তাঁর প্রতিনিধি তৃণমূলের ওই সাংসদের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছেন, বকেয়া চার কোটি টাকা যেন অবিলম্বে তাঁদের সংস্থা দিয়ে দেয়। সাংসদ গুরুঙ্গকে জানিয়েছেন, তিনি নিজে কোনও দিন দার্জিলিঙে যাননি, বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখছেন। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু দলের সাংসদকে রেয়াত করেননি। তাঁর সংস্থার এক কর্তাকে গতকাল পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আজ সংস্থাটি চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য এক কোটি টাকার চেক পাঠিয়ে দিয়েছে। শ্রমিকরা ধর্মঘট করছিলেন। চেক যাওয়ার পরে আজ বিকেল সাড়ে তিনটের সময় সেই ধর্মঘটও উঠে যায়। হাতে হাতে ফল।