কিছু চা বগানের দরজায় এখনও তালা।
নতুন জেলা, তাই মিলবে প্যাকেজও— এমনটাই আশা করেছিলেন আলিপুরদুয়ার জেলার মানচিত্রে ঢুকে পড়া ৬০টি চা বাগানের মালিক-শ্রমিক পক্ষের অনেকেই। জেলা ঘোষণার পরে তোর্সা-কালজানির স্রোতে ২৪ মাস পার হতে চলেছে। রাজ্য সরকার চা শ্রমিকদের জন্য একশো কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করলেও, নতুন জেলা আলিপুরদুয়ারের জন্য পৃথক কোনও প্যাকেজ ঘোষণা হয়নি। তাতে হতাশ জেলার চা শিল্প মহল। বিরোধী শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রশ্ন, নতুন জেলার বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নতিতে বিশেষ বরাদ্দ করা হলে, চা বাগান কেন বঞ্চিত থাকবে? শাসক দলের দাবি, পৃথক প্যাকেজ না থাকলেও চা বাগানের জন্য জেলায় যে বাড়তি পদক্ষেপ হয়েছে, তা-ও কম নয়।
আজ, শনিবার দু’বছর বয়স হচ্ছে আলিপুরদুয়ার জেলার। ঠিক তার আগে এমন টানাপড়েনের মধ্যে কলকাতায় প্রশাসনিক স্তরে দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত, শুক্রবার রাজ্য বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জানিয়েছেন, রাজ্যের চা শিল্প ও চা বাগান শ্রমিকদের স্বার্থে আরও এক বছর গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও শিক্ষা সেস মকুবের প্রস্তাব দিচ্ছেন তিনি। এতে সামান্য হলেও চা শিল্পের আর্থিক সুবিধা হবে বলে সরকারি মহলের দাবি। দ্বিতীয়ত, চা বাগান মালিকদের দুটি সংগঠন ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন এবং টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য বন্ধ চা বাগানগুলি খোলানোর চেষ্টা শুরু করা। এর মধ্যে অবশ্য শুধু আলিপুরদুয়ার নয়, সামগ্রিক ভাবে উত্তরবঙ্গের সব বন্ধ চা বাগানই রয়েছে। তবে আগামী ২৭ তারিখ মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের আগে এই বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ বলেই দাবি প্রশাসনিক কর্তাদের। ওই সফরে তিনি আলিপুরদুয়ারেরও যাবেন।
বর্তমানে ৬০টি চা বাগানের রাজস্ব জমা পড়ছে আলিপুরদুয়ার প্রশাসনের কাছে। চা বাগানের মালিক সংগঠন ডিবিআইটিএ-র সচিব সুমন্ত গুহঠাকুরতা বলেন, ‘‘ডুয়ার্স-তরাইয়ের বেশির ভাগ বড় চা বাগানই এখন আলিপুরদুয়ার জেলার আওতায়। রাজস্ব জমা পড়ছে আলিপুরদুয়ারেই।’’ বিরোধী শ্রমিক সংগঠনগুলির দাবি, নতুন জেলা হলেও শ্রমিক স্বার্থে কোনও সুবিধে মেলেনি। চা বাগানগুলিতে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব শ্রম কমিশনারের। কিন্তু তা দেখার পরিকাঠামো জেলায় যথাযথ নয় বলে অভিযোগ বিরোধী সংগঠনগুলির। চব্বিশ মাস কেটে গেলেও উপ শ্রম কমিশনারের দফতর তৈরি হয়নি জেলায়। বিভিন্ন সরকারি কাজে এখনও জলপাইগুড়ি ছুটতে হচ্ছে। শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রশ্ন, তবে নতুন জেলা তৈরি করে কী লাভ হল?
আরএসপির চা শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি গোপাল প্রধানের অভিযোগ, ‘‘আলিপুরদুয়ার পৃথক জেলা হওয়ায় চা বাগানগুলির অবস্থার কোনও বদল ঘটেনি।’’ বর্তমানে আলিপুরদুয়ার জেলায় মধু, বান্দাপানি, ঢেকলাপাড়া, রেডব্যাঙ্ক ও ডানকান গোষ্ঠীর বাগান মিলিয়ে ১২টি চা বাগানে অচলাবস্থা চলছে। শ্রমিক সংগঠনগুলির অভিযোগ, বন্ধ এবং অচল বাগান খোলার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার টানা পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টে রেশন ব্যবস্থা সরাসরি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ হওয়ায় মালিকপক্ষের সুবিধে হয়েছে বলে দাবি গোপালবাবুর। কংগ্রেস প্রভাবিত চা শ্রমিক সংগঠন এনইউপিডব্লিউ-র কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক প্রভাত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পৃথক জেলা ঘোষণা হওয়ার পরে চা শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ আশা করা হয়েছিল। তা মেলেনি। চা বাগানের রেশন ব্যবস্থাও জেলায় সঠিক ভাবে গড়ে ওঠেনি।’’
তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী দাবি করেছেন, ডুয়ার্স-তরাইয়ের সব চা বাগানের শ্রমিকদের জন্যই রাজ্য সরকার একশো কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সেই প্যাকেজের আওতায় আলিপুরদুয়ারও পরে। সৌরভবাবু বলেন, ‘‘জেলা ঘোষণা হওয়ার পরে একের পর এক চা বাগানকে কেন্দ্র করে পানীয় জল প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। চা বাগানের শ্রমিকদের ৪৫ পয়সা দরে খাদ্যশস্য বিলি হচ্ছে। সরকারি প্রকল্প চলছে বন্ধ বাগানগুলিতে। এগুলিতে জেলার প্যাকেজের থেকেও বেশি সুফল মিলছে।’’ আলিপুরদুয়ার জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা তৃণমূলের চা শ্রমিক সংগঠনের নেতা মোহন শর্মার দাবি, চা বাগানগুলিতে ৩৫ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে। বন্ধ বাগানে ভাতাও চলছে। নিয়মিত পুষ্টি সমীক্ষাও চলছে।