বাভারিয়ার আইনমন্ত্রী উইনফ্রিড বাউসবাককে উত্তরীয় পরাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার মিউনিখে। —নিজস্ব চিত্র।
সিঙ্গুরে টাটা মোটরসের জন্য অধিগৃহীত জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আজ সেই টাটা গোষ্ঠীরই একাধিক সংস্থার তরফে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানানো হল মিউনিখের সম্মেলন মঞ্চে। এই ঘটনাকে রাজ্যের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত বলেই মনে করছে শিল্পমহল।
অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ বলেছেন, ‘‘টাটা গোষ্ঠী আবার বাংলায় আসুক। আপনারা নতুন বাণিজ্যপ্রকল্প শুরু করুন। আমাদের জমি ব্যাঙ্ক রয়েছে। চিন্তার কোনও কারণ নেই। রাজ্যে শুধু একটাই জমি রয়েছে নাকি!’’ রাজ্যের জমি ব্যাঙ্কে ভারী শিল্প করার মতো এক লপ্তে বড় জমি আছে কি না, শিল্পমহলে সেই প্রশ্ন থাকলেও আজ অবশ্য সে প্রসঙ্গ ওঠেনি। বরং উপস্থিত টাটার প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, যে এখানে কোনও ইগোর সমস্যা নেই। কোনও পূর্ণচ্ছেদও নেই। বাণিজ্যে ও সব থাকলে চলে না।
মমতা এ দিন টাটা স্টিলের এমডি টি ভি নরেন্দ্রনকে বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। নরেন্দ্রন বলেন, ‘‘বাংলায় বিনিয়োগ করতে আসুন। বাংলা বদলে গিয়েছে।’’ তাঁর বক্তব্য, এখনই তাঁর সংস্থায় ৬০ হাজার লোক কাজ করে। খুব শীঘ্রই এই সংখ্যা আরও ২০ হাজার বাড়বে। টাটা গোষ্ঠীর আর এক প্রতিনিধি টাটা মেটালিকস-এর সঞ্জীব পুরী বলেন, ‘‘আমরা বাণিজ্যিক গোষ্ঠী। বাংলায় ভাল বাণিজ্য করতে চাই। বাংলায় বিনিয়োগ করার প্রশ্নে আজ কোনও রাজনৈতিক বিতর্কই আর প্রাসঙ্গিক নয়।’’
আজ মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান বক্তব্য ছিল, শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রশ্নে ভাবমূর্তিই আসল চাবিকাঠি। বাংলায় শিল্প হবে না— ৩৪ বছরের বাম শাসনে তৈরি হওয়া এই ধারণা ভাঙতে হবে। উপস্থিত বাণিজ্য কর্তাদের মমতা বলেন, ‘‘কলকাতাই হল সেরা গন্তব্য, আপনারা কলকাতার মাধ্যমে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পৌঁছতে পারবেন।’’
সম্মেলনে জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের আইনমন্ত্রী উইনফ্রিড বাউসবাক বলেন, ‘‘বাংলার সম্পর্কে ধারণাটাই বদলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলায় বাণিজ্য করতে যাওয়ার প্রশ্নে আমরা এখন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’’ তিনি জানান, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে বাংলার অংশীদার হতে পারে বাভারিয়া। জার্মান নেতৃত্বের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, ক্ষুদ্র মাঝারি এবং উৎপাদন শিল্পে যৌথ ভাবে যে কাজ চলছে, তাকে আরও বড় মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হবে। সে দেশের বিভিন্ন সংস্থা ভারতে কাজ করছে। অনেক ভারতীয় সংস্থাও জার্মানিতে কাজ করছে। তাদের মধ্যে আছে কে কে বাঙ্গুর, কমল মিত্তলের পিসিএম গোষ্ঠী।
আজ জার্মান সংবাদমাধ্যমে মমতা বলেছেন, ‘‘কৃষকদের অধিকারের দাবিতে আমাদের আন্দোলন করতে হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমাদের সরকার বা দল শিল্পবিরোধী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের জন্য আমাদের জমি ব্যাঙ্ক আছে। জার্মানির ক্ষুদ্র শিল্পের জন্যও আমরা একটা তালুক গড়ে দিতে পারি।’’ বিএমডব্লিউ-এর হেড অব এশিয়া জ্যান এহলেন-এর কাছে মমতা বাংলায় বিনিয়োগের জন্য জোরালো আবেদন করেছেন তাঁর বক্তৃতায়।
আজকের সম্মেলনে রাজ্য সরকার ‘বাংলা ইন জার্মানি’ নামে ৬ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র দেখিয়েছে, যার মূল বিষয় ছিল— বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের আদর্শ গন্তব্যস্থল হতে চলেছে বাংলা। এর কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে ১) শক্তিশালী রাজনৈতিক জনাদেশ। ২) বৃদ্ধির হার ভাল, রাজ্য দাঁড়িয়ে রয়েছে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিতের উপর। ৩) কেন্দ্রের ‘অ্যাক্ট–ইস্ট’ নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বাংলা। ৪) তৎপর রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসিতে বিশ্বাস করে না। ৫) রাজ্য পরিবেশবান্ধব, সেখানে প্রকৃতিও অনুকূল। ৬) রাজ্য ক্রীড়া ও বিনোদনমুখী। ৭) কন্যাশ্রীর মাধ্যমে মহিলা সশক্তিকরণ ঘটানো হয়েছে।
বাভারিয়ার আইনমন্ত্রী বলার পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা পর্ব। প্রথম বক্তা হিসাবে সঞ্জীব গোয়েন্কা বলেন, ‘‘এখন বাংলার প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে স্বচ্ছতা রয়েছে। জমি পাওয়াটাও কোনও সমস্যা নয়। আমি নিজেই খুব সহজে পেয়েছি। আগে বাংলায় অনেক ম্যানপাওয়ার নষ্ট হতো। এখন বনধ নেই, শ্রমিক সমস্যাও নেই।’’
এর পর জার্মানির হ্যাচেট-এর কর্ণধার জানান, ‘‘সরোজ পোদ্দারের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে ব্যবসা করছি। এখন পরিকাঠামো পরিস্থিতি অনেক ভাল। ইতিমধ্যেই আমরা ৫ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করেছি। পরিকল্পনা রয়েছে আরও ৫ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করার।’’ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সরোজ পোদ্দারও।
আইটিসি-র সিইও সঞ্জীব পুরীর বক্তব্য, ‘‘১০০ বছরেরও বেশি হয়ে গেল কলকাতা আমাদের নিজ গৃহ। আমাদের সংস্থা প্যান–ইন্ডিয়ান ঠিকই, কিন্তু বাংলাই আমাদের প্রধান গন্তব্য।’’ তিনিও পরিকাঠামো ও উৎপাদন ক্ষেত্রে আরও ৬ কোটি ইউরো লগ্নি করার কথা জানান। খুব শীঘ্রই ৮০০ ঘরের সুবিশাল ‘রয়্যাল বেঙ্গল হোটেল’ তৈরির কাজ শুরু করবে আইটিসি। এত বড় হোটেল দেশে আর নেই, আর সেটা হবে কলকাতাতেই।
হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের কর্ণধার পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ও সম্মেলনে বলেন, বাজার পরিকাঠামো এবং দক্ষতার প্রশ্নে বাংলার কোনও তুলনা নেই। মসৃণ ভাবে ব্যবসা করার সব সুযোগই সেখানে রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখন যথেষ্ট সক্রিয়। কর সংক্রান্ত যে সমস্যা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বলে তা ডেটলাইনের আগেই মিটিয়ে ফেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’