বছর দেড়েক আগে তখন দিল্লির রাজনীতিতে উত্থান হচ্ছে অরবিন্দ কেজরীবালের। তাঁর আম আদমির মতো জীবনযাপন, নিরাপত্তা না নেওয়া, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একরোখা লড়াইয়ের ঘোষণা এ সব দেখে চর্চা হতো, এ তো একেবারে পশ্চিমবঙ্গের দিদির মতো! এই তুলনায় সে দিন বিস্তর আপত্তি ছিল তৃণমূল নেত্রীর। টিভি চ্যানেলে এক বার বলেই ফেলেন, “আপ! বাপরে বাপ!”
সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই মঙ্গলবার সন্ধেয় নবান্নে সাংবাদিকদের চকোলেট বিলোলেন! সকালে সর্বাগ্রে টুইট করে কেজরীবালকে যখন অভিনন্দন জানালেন, তখনও দিল্লিতে আপের বিপুল জয় সম্পূর্ণ হয়নি! দুপুরে আপ-কর্ণধারকে ফোনও করে ফেললেন। দাবি করলেন, দিল্লিতে কেজরীবালদের জয় আসলে মানুষের এবং গণতন্ত্রের জয়। মমতার কথায়, “দিল্লির নির্বাচন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেবে। এই নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জায়গা নেই। এই পরিবর্তন দেশের জন্য দরকার ছিল।” আসলে দরকার ছিল মমতারই! সারদা-কাণ্ডে বিধ্বস্ত তৃণমূল গত লোকসভা ভোটে রাজ্যে বড় সাফল্যের পরেও কোণঠাসা। জাতীয় রাজনীতিতে নির্বান্ধব। নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির বিরুদ্ধে পাল্টা লড়াই করতে তৃণমূল নেত্রী মরিয়া, কিন্তু হাতে রসদ নেই! এমন অন্ধকারে তিনি আলোর বিন্দু ঠাওরেছেন কেজরীবালকে। শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু, এই নীতিকে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন দিল্লির হবু মুখ্যমন্ত্রীকে! তাঁর ভাইপো এবং তৃণমূলের ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আরও উৎসাহে ঘোষণা করে দিয়েছেন, “দিল্লির ভোট জানিয়ে দিল, এ বার ‘ভাগ মোদী ভাগ’ হবে!”
কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকে ইদানীং দিল্লিতে সরকারি বৈঠকে যান না মুখ্যমন্ত্রী মমতা। দিল্লির রাজনৈতিক পরিসরে যদিও বা পা ফেলতে চান, বাকিরা সন্তর্পণে তাঁর সঙ্গে দূরত্ব রাখে। এমতাবস্থায় কেজরীবালের আনন্দে এ দিন মমতার আত্মহারা হওয়া দেখে তৃণমূলেরই একাংশ বলছে, দিদি আসলে দিল্লির মাটিতে পা রাখার মতো একটু জমি খুঁজছেন! কেজরীবাল যদি সেটুকু দেন, এই আশাই এখন তাঁর ভরসা!
বাংলার আম আদমি অবশ্য দিদির কাণ্ড দেখে পুলকিতই হচ্ছে!
সোশ্যাল সাইটে মশকরা চলছে। ঠাট্টা চলছে, দিদি প্রথমেই কিছু মাফলার (কেজরীবালের ট্রেড মার্ক) অর্ডার করেছেন! যাঁরা আবার রসিকতা ছেড়ে গম্ভীর রাজনৈতিক যুক্তির পথে যাচ্ছেন তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, আপের লড়াই তো আগাগোড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে! তৃণমূলের মতো সারদা-দুর্নীতিতে অভিযুক্ত একটা দল তাদের সঙ্গে একাসনে বসে কী করে?
এবং দিদির আনন্দে জল ঢেলে আপও তা-ই বলছে! দিল্লির জয়ে কলকাতায় উৎসাহিত আপ নেতা অলোক চতুর্বেদী এ দিন বলেছেন, “রাজ্যে বিধানসভা ভোটে তৃণমূল এবং বিজেপিকে পরাস্ত করার ডাক দিয়ে আমরা লড়ব।” তৃণমূল দিল্লির ভোটে আপ-কে সমর্থন করেছে। তবু তাঁরা এ রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়বেন? আপ কর্মী নাজির হোসেন সরকারের জবাব, “আমাদের লড়াইটা কোনও দলের বিরুদ্ধে নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে। যারা দুর্নীতির সঙ্গে আছে, আমরা তাদের সঙ্গে নেই!”
বিজেপি নেতারাও যুক্তি দিচ্ছেন, বাংলার মানুষের কাছে কেজরীবালের চেয়ে আরাবুল ইসলাম বা অনুব্রত মণ্ডল অনেক বেশি ভাবনার পাত্র! বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক এবং এ রাজ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ যেমন বলেছেন, “এক রাজ্যের ভোটের প্রভাব ওই ভাবে অন্য রাজ্যে পড়ে না। তা হলে তো মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খণ্ডে জয়ের সুবাদে বিজেপি দিল্লিতেও জিতত! পশ্চিমবঙ্গের ভোট মমতার পরীক্ষা! সেখানে কুশাসন, দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নির্বাচন হবে।” এমনকী, বনগাঁ লোকসভা ও কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের আসন্ন উপনির্বাচনেও দিল্লির ঝাড়ু-ঝড়ের কোনও প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করেছেন সিদ্ধার্থনাথ, বাবুল সুপ্রিয়, রাহুল সিংহ থেকে শমীক ভট্টাচার্য, সব বিজেপি নেতাই।
মুখ্যমন্ত্রীর আনন্দ অবশ্য এতে আপাতত ঠেকানো যাচ্ছে না! বিজেপির বিপর্যয়ে দৃশ্যতই উচ্ছ্বসিত মমতা এ দিন রামপুরহাটে প্রশাসনিক সভায় মন্তব্য করেছেন, “এই ঔদ্ধত্য মানুষ মেনে নেয় না।” লোকসভা ভোটের আগে কলকাতায় নিজের প্রথম সভায় মোদী বলেছিলেন, তাঁকে দিল্লিতে জেতালে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দু’হাতেই লাড্ডু পাবেন দিল্লিতে তিনি আর রাজ্যে মমতা। তৃণমূল নেত্রী ঘটনাচক্রে এ দিন লাড্ডু দিয়েই তোপ দেগেছেন মোদীকে। বলেছেন, “ইতনা লাড্ডু খায়া, জো লাড্ডু বিগড় গিয়া! পুরো লাড্ডুতে লাড্ডু! না সরকারে, না বিরোধী!” রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় দাবি তুলেছেন, নীতিগত ভাবে মোদী এবং অমিত শাহের পদত্যাগ করা উচিত! আর এক মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ঝাড়ু দিয়ে আপ পদ্মফুল সাফ করেছে। এ বার জোড়া ফুলের ঝাড়ু দিয়ে বনগাঁ থেকে দূর করা হবে!” আপের জয়ে আসানসোলে রীতিমতো বিজয় মিছিল বের করে ফেলেছে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের অনুমোদিত মোটর ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন! মেদিনীপুরের কিছু জায়গায় পুড়েছে আতসবাজি!
বিজেপি-কংগ্রেসকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য আপের পাশে দাঁড়িয়েছিল সিপিএম-ও। বিজেপিকে পর্যুদস্ত করার জন্য কেজরীবালদের অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রকাশ কারাটরা। কিন্তু মমতার মতো আনন্দে আটখানা হয়নি সিপিএম! দলের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে আপের জয়ের কী প্রভাব পড়বে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে যাঁরা বড় বড় ঘোষণা করছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গে এর পরে তাঁরা সরকার গড়বেন, তাঁরাই তৃণমূলের বিকল্প ইত্যাদি, তাঁদের উদ্দেশে আমরা বিনীত ভাবে বলব আগে দিল্লি সামলান! বাংলা অনেক দূর!”
মমতার কাছে কিন্তু দিল্লি মোটেও দূর নয়! অন্য দিন পুলিশ যাঁদের মুখ্যমন্ত্রীর থেকে দূরেই রাখে, সেই সাংবাদিকদের হাতে চকোলেটের প্যাকেট তুলে দিয়ে মমতা এ দিন বলেছেন, “আমার মতো ভাল বন্ধু পাবে না!” আসলে বন্ধু তাঁর চাই-ই! হোক না বহু দূরের এবং অলীক!