ভরদুপুরে চাষিদের নিয়ে মাঠে নামলেন তিনি। বৃহস্পতিবার সিঙ্গুরের গোপালনগরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
কথা রাখলেন মমতা।
শীর্ষ আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার আগেই সিঙ্গুরের বেশির ভাগ চাষির জমির কাগজপত্র ও ক্ষতিপূরণ বিলি করে দিয়েছে তাঁর সরকার। এ বার নিজেরই স্থির করা সময়সীমার এক দিন আগে চাষযোগ্য করে তোলা সেই জমি চাষিদের হাতে তুলে দেওয়ার (ফিজিক্যাল পজেশন) কাজও শুরু করে দিলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার মাঝদুপুরে সিঙ্গুরের গোপালনগরের মধ্যপাড়ায় চাষিদের নিয়েই মাঠে নেমে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। নিজে হাতে প্রায় সাত একর জমির দখলিস্বত্ত্ব ২৫ জন চাষির হাতে তুলে দেন। তার পরে নিজের হাতেই সেই জমিতে ছড়িয়ে দেন সর্ষেবীজ। চাষিদের হাতে তুলে দেন বীজ, সার-সহ কৃষি সামগ্রী। বাকি জমি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে চাষিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু ‘চাষযোগ্য’ এই জমিতে কোন ফসল, কত দিনে, কী মানের হবে— তা নিয়ে চাষিদের অনেকের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। কেননা, সিঙ্গুরের এই ‘নতুন’ জমির চরিত্র তাঁদের অচেনা। যদিও, সেই সংশয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে মমতার আশ্বাস পূরণের বাস্তবতা। সারা দিনে বিলি হয়েছে মোট ১০০ একর জমি।
সময়ের আগে জমি বিলির কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় এ দিন মমতা যেন আরও প্রত্যয়ী। তিনি বলেন, ‘‘কথা অনেকেই দেয়। কিন্তু সবাই রাখতে পারে না। আমরা সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চাষিদের হাতে জমি তুলে দিলাম। আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই বাকি কাজ হয়ে যাবে। লড়াই থেকে মাঝপথে ফিরতে নেই। নিজের অঙ্গীকার নিজেকেই বুঝতে হয়।’’
১০ বছর আগে টাটাদের গাড়ি কারখানার জন্য সিঙ্গুরের ৯৯৭.১১ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল তদানীন্তন বাম সরকার। গত ৩০ অগস্ট শীর্ষ আদালত ওই অধিগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করে ১২ সপ্তাহের মধ্যে চাষিদের জমি ফেরানোর এবং ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়। আদালতে ঐতিহাসিক এই জয়ের পরেই মমতা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন ওই জমিকে চাষযোগ্য করার পরেই চাষিদের হাতে তুলে দেবেন।
ইতিমধ্যে বেশির ভাগ জমির পরচা এবং ক্ষতিপূরণ চাষিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর চুঁচুড়ায় প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ওই জমিকে চাষযোগ্য করে মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া শুরুর জন্য নিজেই সময়সীমা ধার্য করেছিলেন ২১ অক্টোবর। কিন্তু তার ২৪ ঘণ্টা আগেই সিঙ্গুরে ফের উৎসবের মেজাজ।
বেলা ২টো নাগাদ চলে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে থেকেই মঞ্চে শুরু হয়েছিল গান। সঙ্গে ধামসা-মাদলের তালে আদিবাসী নাচ। দর্শক হিসেবে যাঁরা ভিড় করেছিলেন, সকলেই সিঙ্গুরের মানুষ। সাক্ষী থাকতে চেয়েছেন এক ‘ঐতিহাসিক দিন’-এর। অনুষ্ঠানে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন মন্ত্রীরাও। রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমি ধন্যবাদ দিয়ে মমতাকে ছোট করতে চাই না। সিঙ্গুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে মমতা যে ভাবে দাঁতে দাঁত চেপে নিজে রক্তাক্ত হয়েও চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তা ইতিহাসে লেখা থাকবে।’’ একই সুর শোনা গিয়েছে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গলাতেও।
জমি ফেরত পেয়ে চাষিদের অনেকের মুখেই ফিরে আসছিল আন্দোলনের দিনগুলির কথা। মধ্যপাড়ার রতন কর্মকারের দেড় বিঘে জমি ছিল প্রকল্প এলাকায়। এ দিন হাতে মমতার বিলি করা সার, বীজ নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এর আগে চেক নিয়েছিলাম। গরিব মানুষ, সেই টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। এখন জমি ফিরে পেলাম। ভালই লাগছে।’’ তবে, চাষ নিয়ে সংশয় ধরা পড়েছে তাঁর গলায়। তিনি বলেন, ‘‘এই জমিতে এত দিন চাষ হয়নি। ধান-আলু ফলাতে সময় লাগবে। আপাতত সর্ষে চাষই করব। দেখি কেমন হয়।’’
আন্দোলন-পর্বে অসুখে ভুগে মারা গিয়েছিলেন গোপালনগরের ঘোষপাড়ার চিত্তরঞ্জন ঘোষ। তাঁর স্ত্রী মালতি ঘোষ এ দিন জমি ফিরে পেয়ে বলেন, ‘‘ভালই হল। সরকার চাষে সাহায্য করবে বলছে। দেখি চাষ কতটা হয়!’’ একই সংশয় প্রকাশ করেছেন আরও কয়েক জন।
রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু অবশ্য বলেন, ‘‘কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ আর চাষিদের ইচ্ছাতেই আপাতত সর্ষের বীজ এবং সার দেওয়া হয়েছে। পরে সব দিক বিচার-বিবেচনা করেই চাষিদের পাশে থাকবে কৃষি দফতর।’’
মমতার আশ্বাস পূরণে সিঙ্গুরে উৎসবের আবহ থাকলেও জমি বিলি নিয়ে বিরোধীরা কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না। বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘মমতা এখনও সিঙ্গুরের প্রকৃত সমস্যা উপলব্ধি করতে পারেননি। যখন করবেন, তখন কিছু করার থাকবে না। উনি ঠিক কাজ করলেন কিনা, ভবিষ্যৎই বলবে।’’ বাম পরিষদীয় দলের নেতা সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এখনও মাত্র চার শতাংশ চাষযোগ্য জমি উদ্ধার করতে পেরেছেন। উনি রাজ্যে যুবকদের কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় ডিনামাইট ফাটিয়ে শিল্প মহলে ভুল বার্তা দিলেন। এর ফল ভাল হবে না।’’
প্রশাসন অবশ্য দাবি করেছে, সিঙ্গুরের জমির ৮০ শতাংশই চাষযোগ্য হয়ে গিয়েছে। আগামী ১০ নভেম্বর (সুপ্রিম কোর্টের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ নভেম্বর) পর্যন্ত প্রতিদিনই চাষিদের জমির মালিকানা দেওয়ার কাজ চলবে। প্রত্যয়ী মমতার তাই এ দিন না ছিল কোনও সংশয়, না ভাবনা। মঞ্চে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন দোতারা। কার্তিক দাস বাউলের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন, ‘‘তোমায় হৃদমাঝারে রাখব...’’।
বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী— মমতার পরিচয় যে সিঙ্গুরই!