সরকার গঠনের প্রায় গো়ড়া থেকেই সারদা-কাণ্ডের ঝক্কি সামলাতে হয়েছে তাঁকে। মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার কিছু দিনের মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টের পেয়েছিলেন, রাজ্য জুড়ে কী ভাবে ডালপালা ছড়িয়েছে বিভিন্ন বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা। এবং ইচ্ছে থাকলেও যে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়ার মতো আইনি সংস্থান নেই, তা-ও বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই তাই রাশ নিজের হাতে রাখতে তৎপর হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নের
খবর, রাজ্যের এক দশক পুরনো ইকনমিক অফেন্স উইং (ইওডব্লিউ)-কে ঢেলে সাজার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। অর্থ দফতরের আওতা থেকে সরিয়ে ইওডব্লিউ-কে নিয়ে আসা হচ্ছে স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনে। এই দফতরের মন্ত্রী মমতাই। নবান্নের সিদ্ধান্ত, অনেকটা সিবিআইয়ের মতোই একটি পৃথক ডিরেক্টরেট হবে ইওডব্লিউ। যাদের যাবতীয় নিজস্ব পরিকাঠামো থাকবে। রাজ্যের নতুন বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা (চলতি কথায় ‘চিটফান্ড’) নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী কাজ করবে ইওডব্লিউ। তোলাবাজি ও সিন্ডিকেটের রমরমা রুখতে অপরাধ দমন শাখাকে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নের কর্তাদের বক্তব্য, বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার ক্ষেত্রেও অনেকটা একই ধাঁচের কিন্তু আরও কড়া ওষুধ প্রয়োগ করলেন তিনি।
নতুন ডিরেক্টরেটকে একটা স্বাধীন চেহারা দিতে চায় প্রশাসন। কেমন হবে তার পরিকাঠামো?
স্বরাষ্ট্র দফতরের একাধিক কর্তা জানাচ্ছেন, ইওডব্লিউ-কে এর মাথায় থাকবেন আইজি পদমর্যাদার এক জন আইপিএস অফিসার (বর্তমানে এই শীর্ষ পদে রয়েছেন জাভেদ শামিম)। এ বার ডিরেক্টরেটের অধীনে গোটা রাজ্যকে চারটি ভাগে ভাগ করা হবে। এর প্রতিটির দায়িত্বে থাকবেন এক জন পুলিশ সুপার। তাঁদের অধীনে থাকবেন তিন জন করে ডিএসপি এবং একাধিক ইন্সপেক্টর। সব মিলিয়ে অন্তত ২৫০ জন পুলিশ অফিসার ও কর্মী ডিরেক্টরেটের অধীনে কাজ করবেন। থাকবে সাইবার সেল-সহ একাধিক বিশেষজ্ঞ দল। নতুন আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা লড়ার জন্য ডিরেক্টরেটের আওতায় একটি শক্তিশালী আইন সেলও থাকবে। সেই সেলে থাকবেন রাজ্য সরকার নিযুক্ত আইন অফিসারদের একটি দল।
অর্থাৎ, বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ থেকে শুরু করে বিচার পর্ব পর্যন্ত যাবতীয় ব্যবস্থাই কার্যত এক ছাতার তলায় আসতে চলেছে। এর জন্য ডিরেক্টরেটের নিজস্ব থানা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পৃথক আদালত তৈরির ভাবনাও রয়েছে।
অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগের তদন্ত, চার্জশিট পেশ করা, অভিযুক্তের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, মামলার বিচারের জন্য নির্দিষ্ট আদালত— নতুন ব্যবস্থায় এর সবটাই দেখভাল করবে ডিরেক্টরেট।
বাম আমলে ২০০৩ সালে বিধানসভায় প্রথম বার পাশ হয়েছিল বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ন্ত্রণ আইন। দ্বিতীয় বার ২০০৮-এ। কিন্তু দু’টি বিলই শেষমেশ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়নি। ২০১৩-য় সারদা কেলেঙ্কারির আবহে নতুন করে বিল পাশ করে তৃণমূল সরকার। সেই বিলেরও কিছু ধারা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কেন্দ্র। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত জুনে বিধানসভায় সংশোধনী এনে ফের বিলটি পাঠানো হয় কেন্দ্রের কাছে। গত ডিসেম্বরে সেই বিলে সম্মতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
কী আছে নতুন আইনে?
কোনও অর্থলগ্নি সংস্থা রাজ্যের বাজার থেকে টাকা তুলতে চাইলে সরকারের অনুমোদন লাগবে। রাজ্য সেই তথ্য জানিয়ে দেবে সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিকে। অনুমোদন মেলার পর থেকেই ওই সংস্থার উপরে বিশেষ নজরদারি চলবে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি নির্দিষ্ট সময়ে টাকা ফেরাতে ব্যর্থ হলে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। অভিযুক্তেরা যাতে আগাম জামিন না পান, তারও সংস্থান রয়েছে
নয়া আইনে।
বাম আমলে তৈরি ইকনমিক অফেন্স উইং ছিল অর্থ দফতরের অধীনে। কিন্তু তার হাতে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিপুল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের মতো যথেষ্ট পরিকাঠামো বা আইনি সংস্থান ছিল না। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘এখন নতুন আইন হলেও বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা অর্থ দফতরের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, নানা ফৌজদারি আইনের প্রয়োগ অর্থ দফতরের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। এই কারণেই তাকে স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনে এনে নতুন ডিরেক্টরেট তৈরি করা হচ্ছে।’’