মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে জুনিয়র চিকিৎসকেরা। —ফাইল ছবি।
কোনও পদক্ষেপ করার আগে কলেজ কাউন্সিলকে কথা বলতে হবেই সরকারের সঙ্গে—সোমবার জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর এমন কথাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে বিতর্ক। জুনিয়র চিকিৎসকেরা তো বটেই, সিনিয়র চিকিৎসকদের বড় অংশেরও প্রশ্ন, ‘চিকিৎসা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠন ও পড়ুয়া সংক্রান্ত যে কোনও বিষয়ে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট কলেজ কাউন্সিলের রয়েছে। এই নিয়ম নতুন কিছু নয়। সেটা কি মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানেন না?’’
কলেজ কাউন্সিলের সর্বোচ্চ পদে থাকেন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ। সঙ্গে থাকেন বিভাগীয় প্রধানেরা। যে কোনও কলেজেই পঠনপাঠন-সহ সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কাউন্সিলকে স্থানীয় অভিভাবক বলা যায়। তাই, পড়ুয়া থেকে চিকিৎসক ও অন্য কর্মীদের ভালমন্দের দিক দেখা কলেজ কাউন্সিলেরই দায়িত্ব। সেই ক্ষমতা কেউ খর্ব করতে পারেন না। চিকিৎসকদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে অধ্যক্ষ তথা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের জানিয়ে দিলেন, তাঁদের কাছে আসা অভিযোগ যেন রাজ্য সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সরকার সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, তাতে এই প্রশ্নও উঠছে, তা হলে প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদটির কি আদৌ প্রয়োজন রয়েছে?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রশাসনের প্রাক্তন কর্তারা জানাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় নিয়ম মেনেই প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে তৈরি করা হয় ওই কাউন্সিল। আর তার অধীনে অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি, যৌন হেনস্থার তদন্ত, হস্টেল-সহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ কমিটি থাকে। এই কমিটিগুলি স্বশাসিত। রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের এক প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধানের কথায়, ‘‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের (এনএমসি) নির্দেশিকা মেনেই কলেজ কাউন্সিল-সহ অন্যান্য কমিটি গঠিত হয়, ওই নির্দেশিকা মেনেই কমিটি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সমস্ত কমিটি না থাকলে লাইসেন্স বাতিল করে দিতে পারে এনএমসি। এখানে রাজ্যের কোনও ভূমিকা নেই।’’ তা হলে কী ভাবে মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিলেন?
আর এক প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধানের কথায়, ‘‘স্বাস্থ্যসচিব কিংবা স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার উচিত ছিল, কলেজ কাউন্সিল সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলারই সুযোগ দিলেন না স্বাস্থ্যসচিবকে।’’ উল্টে, কলেজ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সরকার কেন জানে না, সেই প্রশ্ন তুলে দিলেন। ১৩ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে ওই কাউন্সিল সম্পর্কে তিনি কেন কিছু জানেন না, প্রশ্ন তুলছেন সিনিয়র চিকিৎসকদের একাংশ।
প্রাক্তন স্বাস্থ্য কর্তারা জানাচ্ছেন, পঠনপাঠন ছাড়াও পরীক্ষা ব্যবস্থা, মেডিক্যাল কলেজের কর্মীদের বিভিন্ন দাবি, হস্টেল, আইনশৃঙ্খলা-সহ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টিও কাউন্সিলের এক্তিয়ারভুক্ত। কোনও দিনই এ বিষয়ে সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না। প্রাক্তন এক স্বাস্থ্য কর্তার কথায়, ‘‘অনেক সময়ে পড়ুয়া বা কোনও কর্মীকে সাসপেন্ডের মতো বিষয়ে কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়ে তা জানিয়ে দেয় স্বাস্থ্য দফতরকে। কিন্তু বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কলেজের নিজস্ব বিষয় হওয়ায় তাতে হস্তক্ষেপ করে না স্বাস্থ্য প্রশাসন। এ বার কি নিয়ম বদলে গেল?’’ জানা যাচ্ছে, বহু বছর আগে কলেজ ও হাসপাতালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয় অধ্যক্ষের হাতে। সেই সময়েও কলেজ কাউন্সিল সর্বসম্মত ভাবে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিত। যদিও আর্থিক ক্ষমতা ছিল না কলেজ কাউন্সিলের হাতে।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে কলেজ কাউন্সিলের ‘বিরোধিতা’ করলেন, তাতে কি স্থানীয় অভিভাবক হারাবে প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ? ইতিমধ্যেই সেই প্রশ্ন উঠেছে।