শুভেচ্ছা। অশোক ঘোষের ৯৪তম জন্মদিনে তাঁকে ৯৪টি গোলাপ উপহার দিচ্ছেন বিমান বসু। বৃহস্পতিবার ফব-র দফতরে। ছবি: সুদীপ আচার্য।
তৃণমূল এবং বিজেপি-কে রুখতে গোঁড়ামি ছেড়ে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য দলের হাত ধরা উচিত কি না, সেই প্রশ্নে বিতর্ক আরও দানা বাঁধছে বাম শিবিরে। সিপিএমের একাংশের মতোই বামফ্রন্টের কিছু শরিকও দলের তাত্ত্বিক অবস্থানের কথা বলে কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু বামেদেরই অন্য একাংশ আবার মনে করছে, অতীতে নানা সময়ে বৃহত্তর প্রয়োজনে তাত্ত্বিক লক্ষণরেখা ভাঙতে হয়েছে বামেদের। পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরাতেও একই পথে কেন হাঁটা যাবে না, প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে বাম শিবিরে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বামেদের বাড়তি পথ হাঁটতে হবে বলে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব। মমতাকে বিপাকে ফেলার জন্য বামেরা কেন কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং প্রয়োজনে মুকুল রায়ের প্রস্তাবিত মঞ্চের সঙ্গেও কথা বলবে না, সেই প্রশ্নকে সামনে এনে ফেলেছেন গৌতমবাবুই। এই প্রশ্নে জোরদার বিতর্ক চলাকালীনই বিভিন্ন বাম দলের মতামত নিয়ে আগ্রহী হয়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব। আলিমুদ্দিনে আজ, শুক্রবার প্রথমে বামফ্রন্টের শরিক দলগুলি এবং তার পরে ফ্রন্টের বাইরের অন্য বাম দলগুলির বৈঠক ডাকা হয়েছে। একই ভাবে দিল্লির এ কে জি ভবনে রবিবার বসছে ৬টি বাম দলের বৈঠক। ললিত-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে বামেদের বিক্ষোভে নামা উচিত বলে সিপিএমকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন এসইউসি-র সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি জবাবি চিঠিতে প্রভাসবাবুকে জানিয়েছেন, রবিবারের বৈঠকেই সব বিষয়ে আলোচনা হবে। কলকাতার বৈঠকের উপলক্ষও আশু আন্দোলনের কর্মসূচি। কিন্তু সেই অবসরেই কংগ্রেস-প্রশ্নে নিজেদের মত জানাতে পারেন বিভিন্ন বাম দলের নেতৃত্ব।
তবে বামেদের এই বৈঠকী চর্চার আগেই আসরে নেমে পড়েছেন তৃণমূল নেত্রী! ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রবীণ রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের ৯৪তম জন্মদিনে বৃহস্পতিবার তাঁকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, সশরীর অশোকবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান। ফোনে বার্তা পাঠানোর পরে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে দূত মারফত ফুল-মিষ্টিও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ফ ব-র রাজ্য দফতরে। বাম জমানার শেষ দিকে অশোকবাবুর সঙ্গে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতার সম্পর্ক মসৃণই ছিল। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেই রেড রোডে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন পালন নিয়ে রাজ্য সরকারের সংঘাত বেধেছিল ফ ব-সহ বাম নেতৃত্বের। তার পরে আবার তৃণমূলকে রুখতে কংগ্রেস এবং মুকুল রায়ের সঙ্গেও নৈকট্যের প্রস্তাব যখন উঠছে বাম শিবির থেকে, সেই সময়েই বর্ষীয়ান বাম নেতার প্রতি মমতার সৌহার্দ্যের বার্তায় ভিন্ন তাৎপর্য দেখছেন কেউ কেউ।
ফ্রন্ট শরিক ও তার বাইরের বাম শক্তিগুলির মধ্যে এসইউসি বা সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের মতো কয়েকটি বাম দল ঘোষিত ভাবেই তীব্র কংগ্রেস-বিরোধী। কিন্তু আজকের বৈঠকে আগামী ২ সেপ্টেম্বরের যে সাধারণ ধর্মঘট নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা, তাতে বামেদের পাশাপাশি কংগ্রেস এবং সঙ্ঘ পরিবারের শ্রমিক সংগঠনও সামিল! আন্দোলনের প্রশ্নে এই এক মঞ্চে আসার ঘটনাকেই আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রসারিত করতে চান বামেদের একাংশ। ফ্রন্টের শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, ‘‘বফর্স-প্রশ্নে রাজীব গাঁধীর সরকারকে কোণঠাসা করার সময় বামেরা তো অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত ধরেছিল। তারও আগে ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পরে কংগ্রেস-রাজের অবসান ঘটাতে জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের সময় জনসঙ্ঘ ছিল বামেদের পাশাপাশি। এখনও তো পশ্চিমবঙ্গে প্রধান প্রশ্ন গণতন্ত্র ফেরানো। তা হলে শুধু তত্ত্ব আঁকড়ে থেকে লাভ কী?’’
বামফ্রন্টের বাইরের একটি বাম দলের রাজ্য সম্পাদকের যুক্তি, তৃণমূলের গ্রহণযোগ্য বিকল্প সামনে নেই বলে ভোটারদের একাংশ মমতার দলকেই ভোট দিচ্ছেন। কংগ্রেস, বাম-সহ বৃহত্তর ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি একজোট হলে বিরোধীদের আসন সাধারণ হিসেবে বাড়বে তো বটেই। ভোটারদের ওই অংশও তৃণমূলের বিকল্প পাবেন। বিপদ হবে শাসক দলেরই। তবে চেনা ছকের বাইরে যাওয়ার রাস্তা যে কঠিন, ইঙ্গিত দিয়ে বাম শরিক সিপিআই সদ্যই বিহারে জনতা পরিবার ও কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার প্রস্তাব ফিরিয়েছে!
বাম শিবিরে এই চর্চার মধ্যেই উল্টো দিকের জল্পনা তৈরি করেছে সৌজন্যের মোড়কে অশোকবাবুকে মমতার ফোন। সরেজমিনে ধস-বিধ্বস্ত দার্জিলিং দেখতে গিয়ে সেখান থেকেই তিনি ফোনে ধরেছিলেন ফ ব-র রাজ্য সম্পাদককে। অশোকবাবুর কথায়, ‘‘মমতা বলেছেন, ওঁর ইচ্ছা ছিল আজই আমার কাছে এসে দেখা করার। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাঁকে উত্তরবঙ্গে চলে যেতে হয়েছে। উনি জানিয়েছেন, পরে এক দিন এসে দেখা করতে চান।’’