নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি মমতা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
রাজ্য সরকারই নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশকে। লোকসভা ভোটের ফলাফল এবং পরবর্তী পরিস্থিতিতে সেই সরকার এ বার সরাসরি পুলিশের দিকেই আঙুল তুলল! প্রশাসনিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, সোমবার নবান্ন সভাঘরের প্রশাসনিক বৈঠকে অন্তত হাফডজন মন্ত্রী পুলিশের ‘অসহযোগিতা’র বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, প্রশাসনিক এবং পুলিশকর্তাদের সামনে।
আধিকারিক মহলের একাংশের ধারণা, পুলিশের ভূমিকা শাসক শিবিরকে যে ‘সন্তুষ্ট’ করতে পারছে না, এ দিনের পরিস্থিতি তারই প্রমাণ। অনেকে জানাচ্ছেন, ২০০৯ সালে একই ভাবে পুলিশকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার।
এ দিনের বৈঠকে দফতর-ভিত্তিক সরকারি কাজকর্মের বিশ্লেষণের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন কিছু মন্ত্রী। তার পরে পুলিশের উপরে নিজের ক্ষোভ উগরে দেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীও। এবং তাঁর সেই ক্ষোভ থেকে পুলিশ সুপার বা রাজ্য পুলিশের ডিজি, কেউই রেহাই পাননি। বৈঠকে মেদিনীপুরের এক মন্ত্রী অভিযোগ করেন, ঘরছাড়া কর্মীদের ফেরানো যাচ্ছে না। পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও লাভ হচ্ছে না। পুলিশ যে-ভাবে কাজ করছে, তাতে শাসক দলের ‘জায়গা’ চলে যাচ্ছে। তাঁকে সমর্থন করে আরও কয়েক জন মন্ত্রী জানান, শাসক দলের আক্রান্ত কর্মীদের অভিযোগ সহজে নিচ্ছে না পুলিশ। যদিও বা নিচ্ছে, মামলা দেওয়া হচ্ছে লঘু ধারায়। তাতে জামিন পেতে সুবিধা হয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তদের।
মমতাকে অন্য এক মন্ত্রী জানান, তাঁকে ফোনে অকথ্য ভাষায় অপমান করা হচ্ছে। ফোন রাখার আগে বলা হচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’। এটা করছে কিছু অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি। পুলিশকে তাদের ফোন নম্বর দিয়েও কোনও কাজ হচ্ছে না। ‘‘পুলিশ ব্যালান্স করে চলছে,’’ বলেন এক মন্ত্রী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্রকে নিপাট ভদ্রলোক বলে উল্লেখ করে তাঁকে আরও শক্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হচ্ছে না, পুলিশ সুপারদের উদ্দেশে প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। উত্তরবঙ্গের এক আইপিএস অফিসারের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চান মুখ্যমন্ত্রী। ‘অসুস্থ’ হয়ে পুলিশের দায়িত্ব যে পালন করা যায় না, সেটাও তাঁকে বুঝিয়ে দেন। নিচু তলার পুলিশের একাংশ যে ‘কথা শুনছেন না’, তার পিছনে বিজেপির তরফে দেওয়া প্রলোভন কাজ করেছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নিশানায় যিনিই থাকুন না কেন, তাঁর বার্তা স্পষ্ট এবং সার্বিক।’’ থানাগুলি কেন ‘কথা’ শুনছে না, তা নিয়ে কলকাতা এবং বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারকেও এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দায়ের করা এফআইআরের তালিকা চেয়েছেন মমতা। তার প্রেক্ষিতে কী পদক্ষেপ করা হয়েছে, চান সেই রিপোর্টও। বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘পুলিশকে আরও শক্ত হতে বলা হয়েছে। ওসি, এসআই-রা কেউ কেউ ঠিক কাজ করছেন না। কারা কারা পদক্ষেপ না-করে গুন্ডামিতে মদত দিচ্ছেন, খোঁজ নিচ্ছি। এর পিছনে কী খেলা আছে, সেটাও দেখছি। শক্ত হাতে মোকাবিলা হবে।’’ রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় মুখ্যসচিব মলয় দে-কে সরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
সরকারি পরিচয়পত্রধারী সাংবাদিকেরা নবান্নের উঁচু তলায় কেন অবাধে ঘোরাফেরা করছেন, মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সেই প্রশ্ন তুলেছেন।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন জনস্বাস্থ্য কারিগরি, পূর্ত দফতর মুখ্যমন্ত্রীর ধমক খেয়েছে। কেন্দ্র তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি দেওয়া প্রকল্পের প্রচার যে-ভাবে হয়েছে, রাজ্যের প্রকল্পের প্রচার সেই তুলনায় দানা বাঁধেনি বলেও উষ্মা প্রকাশ করেন মমতা। কিছু অফিসারের বিরুদ্ধে কথা না-শোনার অভিযোগ করে মমতা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসকদের। প্রশাসনের অন্দরে এক শ্রেণির অফিসার সরকারি প্রকল্পগুলির নিবিড় বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলে মুখ্যমন্ত্রী একটি নতুন কমিটি গড়ে দিয়েছেন। প্রকল্পে নজরদারির পাশাপাশি সেই সম্পর্কে মানুষের অভিযোগও শুনবে ওই কমিটি। তার জন্য টোল-ফ্রি নম্বর ১৮০০-৩৪৫-৮২৪৪। এসএমএসে অভিযোগ জানাতে হবে এই নম্বরে: ৯০৭৩৩০০৫২৪)। থাকবে ই-মেল আইডি (wbcmro@gmail.com)। ডিএম, এসপি-রা এই কাজে নোডাল অফিসার নিয়োগ করবেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এই প্রকল্পগুলির জন্য কারও থেকে এক পয়সা নিই না আমরা। প্রায় সব প্রকল্পই বিনা পয়সায় হচ্ছে। এখান থেকে দু’-এক পয়সা করে নিজেদের পকেটে ঢোকাবে। সরকার যখন তাদের ধরবে, তখন চুরি ঢাকার জন্য এক বার এ-দল আর এক বার অন্য দল করবে— এটা হবে না।’’
পুলিশের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের কথা শুনে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায় এ দিন বলেন, ‘‘পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকলে তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই সবার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত। কারণ, পুলিশ তো ওঁরই অধীনে।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।